কলকাতা: অতিমারির আড়মোড়া ভেঙে আবার ছন্দে ফিরছে জনজীবন। মহামারির শোক কাটিয়ে, শরতের ছাতিম ফুলের সুবাস পেতে মরিয়া বাঙালি। ওয়ার্ক ফ্রম হোম, প্যান্ডেমিকের বিধি-নিষেধে মনখারাপের দিস্তা যে জমতে জমতে পাহাড় হয়েছে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এসব ঝুট-ঝামেলায় মন যখন ব্যাকুল, তখন তিস্তার দেশই অবসর যাপনের সেরা ডেস্টিনেশন হতে পারে। 


আসছে পুজোর ছুটিতে পাহাড়ে পাড়ি দেওয়ার কথা যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা চিরাচরিত পথে পা না বাড়িয়ে ছক ভাঙার গল্প জমাতে চলে যেতে পারেন এই পথে। দার্জিলিং বা গ্যাংটকের মতো চেনা সেই ভিড় এখানে পাবেন না। বরং কাঞ্চনজঙ্ঘার ঘ্রাণ আর নির্জন পাহাড়ি পথের বাঁকে একাকী হারিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে ভাল সুযোগ রয়েছে এখানেই। 'পাহাড়ের পায়ের কাছে গহন অরণ্য' বা 'একেবারে চূড়ায়, মাথার খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী, চরাচরে তীব্র নির্জনতা।' ঠিক যেমন পড়েছিলেন বই-এর পাতায়। একেবারে তেমনটাই। তাহলে দেরি না করে বেরিয়ে পড়ুন। অফবিট এই ডেস্টিনেশনগুলোয় গিয়ে কোথায় থাকবেন বা কী করবেন তার আনুমানিক একটা ছক কষে দিচ্ছে এবিপি লাইফ। 




তিনচুলে: পর্যটন মানচিত্রে তিনচুলে এখনও তেমন বিখ্যাত নাম নয়। তবে যাঁরা বেড়াতে ভালবাসেন তাঁরা ইতিমধ্যেই এই জায়গার নাম শুনে ফেলেছেন হয়ত। কংক্রিটহীন জঙ্গলের স্নিগ্ধতায় একেবারে নির্জন পাহাড়ি গ্রাম। এখানে পাহাড় আড়মোড়া ভাঙে পাইনের কোলে। চোখের সামনে অনবরত ধরা দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ শোভা। তিনচুলের সানরাইজ পয়েন্ট থেকে পুবে কালিম্পং, পশ্চিমে মহানন্দা অভয়ারণ্য, উত্তরে টাইগার হিল আর দক্ষিণে নামচি দৃশ্যমান। সবমিলিয়ে প্রকৃতি তার দিগন্ত বিস্তৃত রূপের ডালির নিয়ে এখানে বিরাজমান। অফবিট ডেস্টিনেশনগুলোর মধ্যে তিনচুলে তাই অন্যতম পছন্দ হতেই পারে এই পুজোয়।



কীভাবে যাবেন? অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে চাইলে গাড়িতে না চেপে বাইক ভাড়া করতে পারেন। দার্জিলিং বাসস্ট্যান্ডে কথা বলে নিলে ওরাই বাইকের ব্যবস্থা করে দেবে। অথবা শিলিগুড়ি থেকেও বাইক ভাড়া পাওয়া যায়। (নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে শেয়ার জিপেও যেতে পারেন) দার্জিলিং থেকে ঘুম স্টেশন পেরিয়ে সিকিম-কালিম্পং যাওয়ার রাস্তা ধরুন। ঋষি রোড, পেশক রোড হয়ে সিক্সথ মাইল বাজার পৌঁছে ইউটার্ন। রাস্তা চেনার প্রয়োজন নেই, পথ হারাবেন বলেই তো পথে নামা, তাই না? কোনদিকে যাবেন জিজ্ঞেস করে নিন ট্রাফিক গার্ডকেই। তার পর তাঁদের নির্দেশ মতো রাস্তা যেমন যেমন বাঁক নিচ্ছে এগিয়ে যান। যাওয়ার পথেও নিরাশ হবে না। প্রকৃতির অপরূপ শোভে আপনাকে মুগ্ধ করবে যাত্রাপথে। 






সিক্সথ মাইল থেকে বাইকে এই রাস্তায় তিনচুলে পৌঁছতে একটু বেশি সময় লাগলেও এটাই নিরাপদ। সিক্সথ মাইল থেকে লামাহাট্টার রাস্তা ধরেও তিনচুলে আসতে পারেন। সে রাস্তা আরও সুন্দর এবং সময় কম লাগলেও বিপদসঙ্কুল। অভিজ্ঞ স্থানীয় কেউ সঙ্গে না থাকলে ওই পথ এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। প্রতি ঘণ্টায় ৩০ কিমি বেগে গাড়ি চালালে দার্জিলিং থেকে তিনচুলে পৌঁছতে সময় লাগবে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট মতো। খেয়াল রাখবেন সন্ধে নামার আগেই যেন পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে। সন্ধে নামলে এই জঙ্গলের রাস্তায় নৈব নৈব চ। সে ক্ষেত্রে লামাহাট্টা রাস্তার রিস্ক নিতে পারেন। তবে পাহাড়ি রাস্তায় অভিজ্ঞ কাউকে সঙ্গে নিন। তিনচুলের যে হোটেলে থাকবেন সেই হোটেলের কাউকে ডেকে নিন। 



কোথায় থাকবেন: এখানে একমাত্র গুরুং কটেজেই থাকা যায়। যোগাযোগ: ৯৯৩৩০৩৬৩৩৬


তাগদা: লামাহাট্টা ঢোকার আগে তাকদা চা-বাগানের রাস্তা বাঁ দিকে বেঁকে গিয়েছে। একটা বাঁক ঘুরলেই সবুজের সাম্রাজ্য। ওই যে দূরে পাহাড়ের ওপর থেকে শহুরে গন্ধ ভেসে আসছে, ওটাই দার্জিলিং। এই রাস্তা ধরে খানিকটা গেলেই গ্লেনমেরি হোম স্টে। তাকদা বাগানের সীমানায় এটাই একমাত্র অতিথিনিবাস। ভাঙাচোরা রাস্তা আরও নীচে গ্লেনবার্ন চা-বাগানে নেমে গিয়েছে। এখানে এক রাত থাকতে পারেন। 





  • কীভাবে যাবেন: শিলিগুড়ি থেকে তাকদা চা-বাগানের গ্লেনমেরি হোম স্টে প্রায় ৬৫ কিমি। গাড়ি ভাড়া করতে পারেন অথবা তিনচুলে যাওয়ার জন্য যে বাইক নিয়েছেন তাতেও আসতে পারেন। দার্জিলিং থেকে কমবেশি ৩০ কিমি। এখান থেকে সহজে গ্লেনবার্ন চা-বাগান ও লামাহাট্টা ঘুরে আসা যাবে। সময় লাগতে পারে সর্বসাকুল্য ৩-৪ ঘণ্টা।

  • কোথায় থাকবেন: গ্লেনমেরি হোমস্টে-তে ১জনের জনপ্রতি ভাড়া আনুমানিক ৪০০০ টাকা। ফোন: ৯৭৩৩৪৫৪৭৭৯




লামাহাট্টা: রাজ্য পর্যটন মানচিত্রে মোটামুটি পরিচিত ডেস্টিনেশন লামাহাট্টা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে লামাহাট্টা উচ্চতা ৫ হাজার ৭০০ ফুট। চা বাগান ঘেরা পাহাড়ি পথের নৈসর্গিক দৃশ্যপট সাজিয়ে আপনার অপেক্ষায়। এখানে নিরিবিলি সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন। দার্জিলিং ও কালিম্পংয়ের ঠিক মাঝামাঝি লামাহাট্টায় সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পাইন জঙ্গল। সেখানেই লুকিয়ে ছোট্ট পাহাড়ি এই জনপদ। সবুজের সাম্রাজ্য। এখানে প্রকৃতি নিজেকে উজার করেছে।পাইনদের বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জল টলমলে ছোট্ট হ্রদ। নামার পথে লেপচুতে ‘প্যাসান ফ্রুট জুসে’চুমুক দিতে ভুলবেন না। পাইন ও ধুপি গাছের জঙ্গল এবং ইকো টুরিজম পার্কই এখানকার প্রধান আকর্ষণ।  তিস্তা বাজার পার হয়ে পথ বেঁকে গিয়েছে। এই পথে পীচ রঙা রাই ফুলের সৌন্দর্য আর বুলবুলে গানে ভেসে যেতে যেতে মনে হতেই পারে ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না’। লামাহাট্টা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বসতি এলাকা। রয়েছে মনাস্ট্রি। পাইন-ধূপি গাছের আস্তানা। সেখানেই ডানা ঝাপটায় হরেক রকম পাখি। দার্জিলিং থেকে লামাহাট্টার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। শহুরে কোলাহলে অভ্যস্ত কান এখানকার জঙ্গলে হাঁটতে বেরোলে পাবে নির্জনতার আস্বাদ। লামাহাট্টা থেকেও জংলি পথে হাঁটতে হাঁটতে ট্রেকিং করে পৌঁছে যেতে পারেন আরেক টুরিস্ট স্পট তাকদায়। 





  • কীভাবে যাবেন: শিলিগুড়ি থেকে ভাড়া গাড়িতে অথবা শেয়ার জিপেও ঘুম স্টেশন পর্যন্ত না এগিয়ে জো বাংলোয় নেমে পড়া যায়। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার পথ। 


বড়া মংওয়া: একপাশে তিস্তা-রঙ্গীতের মিলিত প্রবাহ, অন্যপাশে কালিম্পং পাহাড়। দার্জিলিং থেকে ৩৫ কিমি দূরে অবস্থিত এই মঙ্গোয়া গ্রাম। এনজেপি থেকে গাড়িতে ঘণ্টা দেড়েক। সেবক রোড ধরে যাওয়ার পথে তিস্তা রিভার রাফটিং করতে পারেন। ৬ জনের খরচ পড়বে ৫০০০ হাজারের মতো। খানিক দরদাম করে কমাতে পারেন। এরপর গাড়িতে পৌঁছে যান ছোট্ট গ্রামটিতে। এখানে মূল আকর্ষণ অরেঞ্জ বাগান, তমাং মনেস্টি, টি গার্ডেন, রডোডেনড্রন, ওক, পাইন গাছের বনরাজি, কাঞচনজঙঘার মনোরম দৃশ্য, কালিম্পং হিল তিস্তা ও রঙ্গীত নদীর মিলিত সৌন্দর্য সব কিছু মিলিয়ে একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মিলিয়ে পুজোর ছুটিতে লোভনীয় ডেস্টিনেশন হতে পারে এই পথ। এখানে বেশ কয়েকটি হোমস্টে রয়েছে। অফ সিজনে আগে বুকিং-এর ঝামেলা এড়াতে চাইলেও পুজো পা ভ্রমণ মরসুমে এই রিস্ক না নেওয়াই শ্রেয়। ঘুরে আসতে পারেন ছোটা মাংওয়া-ও। 





  • কীভাবে যাবেন: শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি অথবা বাইকে আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টার পথে পৌঁছে যাবেন এখানে। (দার্জিলিং হয়েও যাওয়া যায়)

  • কোথায় থাকবেন: অরেঞ্চ ভিলা। যোগাযোগ: ৮১১৬৭০৮০২৬


উল্লেখ্য, গোটা ট্যুরটি সম্পূর্ণ করতে হাতে অন্তত ৫ দিন সময় নিন। জনপ্রতি খরচ হতে পারে ৬০০০-৭০০০ টাকা। গ্রুপ বড় হলে খরচ কমবে। সিজন এবং অফ সিজনের হিসেবেও খরচের হেরফের হতে পারে। তাই বেরনোর আগে ভাল করে জেনে নিন। আগে থেকে হোটেল এবং যাতায়াতের গাড়ি ঠিক করে খরচের ছক কষে তবেই যান। করোনার দীর্ঘ ভয়াবহতা কাটিয়ে জমিয়ে কাটুক আসছে পুজো।