২৬ মার্চ, ২০২৩
ঘুম  যখন ভাঙল আধো চোখে চেয়ে দেখি প্রকাণ্ড চওড়া এক হাইওয়ে ধরে বাস ছুটে চলেছে। দিনের আলো পুরো ফোটেনি। চারপাশটা যেন ভিজে ভিজে। হয়তো এদিকে বৃষ্টি হচ্ছিল। বাসের যাত্রীরা সবাই তখনো ঘুমোচ্ছে। শুধুমাত্র চালক একা লক্ষ্য স্থির রেখে বসে। কিছুক্ষণ গা এলিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। খানিক বাদে ড্রাইভার সাহেব জানিয়ে দিলেন আমরা আমস্টারডাম পৌঁছে গেছি। বাসসুদ্ধ যাত্রী ধড়মড়িয়ে লাফিয়ে উঠল। আমরা সবাই লাগেজ নিয়ে নেমে পড়লাম। হোটেল বুকিং করাই ছিল। সবজান্তা গুগল জানিয়ে দিল আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে ট্রামে চড়ে খানিকটা যেতে হবে আমাদের গন্তব্যে। যথারীতি সব শহরের মতো ট্রাভেল কার্ড কেনা হল। খানিক বাদে আমরা পৌঁছে গেলাম আমস্টাররডাম মূল স্টেশনে। সেখান থেকে বেরোতে আবারও একরাশ দমকা ঠান্ডা হাওয়া আমাদের কাঁপিয়ে দিল। স্টেশনের সামনে রাস্তা পেরোলেই হারবার। তার সামনেই আমাদের হোটেল। 


তবে এবার ইউরোপের সর্বত্র একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হল। হোটেল হোক বা এয়ার বিএনবি সর্বত্র এখন চেকিং টাইম বিকেল তিনটে। তাই কোনও শহরে দিনের প্রথমার্ধে গিয়ে পৌঁছলে হোটেলে ঢুকতে বেশ বেগ পেতে হবে।


আপাতত আমরা হোটেলের ক্লোক রুমে মালপত্র দেখে বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে। ঘোরার আগে একটু এনার্জি সংগ্রহ করতে হবে। তাই জমিয়ে ব্রেকফাস্ট এবং গরম কফি খাওয়া হল। এবার প্রথম গন্তব্য এ শহরের অন্যতম আকর্ষণ ভ্যান গঘ মিউজিয়াম। যুগে যুগে চিত্রশিল্পীরাতো বটেই শিল্পানুরাগীরাও অনুপ্রাণিত হয়েছেন ভ্যান গঘের রঙের ব্যবহারে। এক বর্ণময় শিল্পী জীবন। তাঁর আঁকা ছবি, স্টারি নাইট হোক বা সানফ্লাওয়ার, যুগে যুগে নানা ধারা শিল্প সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলেছে। তবে যে ডিজিটাল মিউজিয়ামের ছবি মাথায় ছিল সে প্রদর্শনী দেখা হল না। কারণ সেটা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শহরে প্রদর্শিত হয়। বরাবরের মত সামনে দাঁড়িয়ে এই মহান শিল্পীর ছবি দেখার যে রোমাঞ্চ তা এবারও এতটুকু কমেনি। যাঁরা এই মিউজিয়াম দেখতে চান তাঁরা অবশ্যই অনলাইনে ঢোকার টিকিট কেটে যাবেন। কারণ এখানে পৌঁছে কাউন্টারে ঢোকার টিকিট কাটার কোনো ব্যবস্থা নেই।
ভ্যান গঘ মিউজিয়ামের অদূরে রয়েছে রিক্স (Rijks) মিউজিয়াম। সেখানে তখন ভারমিরের এক প্রদর্শনী চলছে। রিক্স মিউজিয়ামের বাড়িটাই এক দারুণ স্থাপত্যের নিদর্শন। এর অন্যতম আকর্ষণ রামব্রাঁ’র আঁকা দ্য নাইট ওয়াচের মত বিরাট ক্যানভাস। এখানেও ভ্যান গঘের আঁকা বেশ কিছু ছবি রয়েছে। দেওয়াল জোড়া ওয়াটারলু যুদ্ধের ছবি বিস্ময় জাগায়। এছাড়াও নানা ছবি, ভাস্কর্য, আসবাব এবং নানা সামগ্রীতে সমৃদ্ধ এই সংগ্রহশালা। 


 



ভ্যান গঘ


 



ওয়াটারলুর যুদ্ধ


এরপর আমাদের গন্তব্য মাদাম তুসোর মিউজিয়াম। বিশ্বের নানা দেশে মাদাম তুসোর মোমের মূর্তির সংগ্রহশালা রয়েছে। তেমনই অ্যামস্টারডাম শহরেও রয়েছে। হলিউড, মিউজিক, স্পোর্টস, আর্টস সহ নানা থিমের ঘরে রয়েছেন বিশিষ্ট জনেরা। এখানে ভারতীয়দের মধ্যে একমাত্র স্থান পেয়েছেন মহাত্মা গান্ধী। তবে গোটা সংগ্রহশালাই দর্শকদের সঙ্গে ইন্টারেকটিভ করে তৈরি করা হয়েছে। শুধু বিশিষ্ট নয় বেশ কিছু কার্টুন চরিত্রও এখানে উপস্থিত। তবে খানিকক্ষণ এখানে কাটিয়ে দেখলাম আজও মেরিলিন মনরোর সঙ্গে ছবি তোলার লাইন সবচেয়ে বেশি।


বেরিয়ে দেখি শহরের পথে বহু মানুষ। এসময়ে ইউরোপে দিনের আলোর স্থায়িত্ব অনেক বেশি। ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যে ছ’টা বেজে গেলেও আকাশে তখনও রোদ। সবাই যে যার মত ছুটছেন। হারবারের ধারে ফিরে গিয়ে কড়া রোদেও দাঁড়ানো দায়। কারণ কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। গুগল ওয়েদার দেখাচ্ছে তখন তাপমাত্রা মাত্র তিন ডিগ্রি।



অ্যামস্টারডাম শহরের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে দেহব্যবসার ইতিহাস। ঐতিহাসিক ভাবে দেখা যায় যে কোনো বন্দরের কাছে যৌনপল্লি গড়ে ওঠে। হয়তো সেই ধারাতেই এ শহর গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে এখানকার যৌনপল্লি বা রেড লাইট এরিয়া। ঐতিহাসিকরা মনে করেন প্রায় পনেরোশো শতাব্দী থেকে এই শহরে যৌনপল্লির অস্তিত্ব রয়েছে। প্রাচীনকালে যৌনকর্মীরা শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ালেও পরে শহরের প্রাচীন অংশে তাঁরা স্থায়ী হন।  আজও এ শহরের পর্যটকদের কাছে এই এলাকার আকর্ষণ রয়েছে। একদিকে শহরের প্রাচীন যৌনপল্লীর জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হওয়া অন্যদিকে আধুনিক যৌনপল্লি দুয়ে মিলে অতি জনপ্রিয় এ শহরের রেড লাইট এরিয়া ট্যুর। সামান্য দক্ষিণায় গাইড নিয়ে ঘুরে দেখতে পারেন এক ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা। হোটেলে ফিরে জানলার বাইরে আলো ঝলমলে রাতের হারবার সঙ্গে গরম খিচুড়ি, মোটা মোটা আলু ভাজা আর ডিম ভাজা তাও অনবদ্য।



২৭ মার্চ, ২০২৩

ছোটবেলায় যখন হিন্দি ভাষা খুব বেশি বুঝতাম না, হিন্দি সিনেমা টিভিতে দেখায় একটা নিষেধাজ্ঞা ছিল, সে সময় লুকিয়ে একটা সিনেমা দেখেছিলাম। ছবির নায়ক অমিতাভ বচ্চনকে দেখার লোভে সিনেমাটা দেখা। সামগ্রিকভাবে সিনেমার গল্প তেমনভাবে মনে ধরেনি কিন্তু একটা গানের দৃশ্য যেন মনের কোণে ছাপা হয়ে গিয়েছিল। দিগন্ত বিস্তৃত এক মাঠ। গোটা মাঠে হলুদ আর লাল ফুল ফুটে রয়েছে। তার মধ্যে শৈশবের আমি স্বপ্নের নায়ককে দেখে কেমন যেন উদ্বেলিত হয়ে পড়েছিলাম। গানটা ছিল ‘ইয়ে কাঁহা আগয়ে হাম’। সিনেমার নাম সিলসিলা। অনেক পরে জেনেছিলাম বিদেশে শ্যুটিং হয়েছিল ওই দৃশ্য, আর ওই ফুলটার নাম টিউলিপ। পরে আরও অনেক সিনেমায় একই রকম দৃশ্য দেখেছি। তবে প্রথম দেখা ওই গানের দৃশ্যটা আমার বরাবরই খুব প্রিয়। এবার যখন বেড়াতে যাবার প্ল্যান হচ্ছে, নানা দেশ নিয়ে আলোচনা, কোথায় কোথায় যাব খুঁজে দেখা, সবের মধ্যে আমার পছন্দ ছিল অ্যামস্টারডাম। কারণ আমরা এমন সময়ে ঘুরতে যাচ্ছি সেই বসন্তেই তো ফুটবে ছোটবেলার স্বপ্নের সেই ফুল। যার আকর্ষণ আমার কাছে স্বর্গের পারিজাতের চেয়ে কিছু কম নয়।


 



স্বপ্নের ফুল



অ্যামস্টারডাম শহর থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে কিউকেনহফ গার্ডেন। বছরের এই সময়টা দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন দিগন্ত বিস্তৃত সেই টিউলিপ উদ্যান দেখতে। আমরাও সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। আজ আমাদের সারাদিন ট্যুর প্ল্যান করা রয়েছে। সবটাই কলকাতা থেকে বুকিং করা। হোটেল থেকে বেরিয়ে হার্বার পেরোতেই শহরের মেন ট্যুরিস্ট সেন্টার। সেখান থেকে আমাদের বাস ছাড়ল। ঝকঝকে সাজানো শহর ছাড়িয়ে সবুজের হাতছানি। দূরে দূরে উইন্ডমিল ঘুরে চলেছে আপন ছন্দে। খানিক পরে আমাদের যেখানে নামানো হল সেখান থেকে আমাদের দেড় ঘন্টার ক্রুজ ভ্রমণের ব্যবস্থা। কাঁচে ঘেরা ঝাঁ চকচকে ক্রুজ। তাতে আমরা জনা কুড়ি যাত্রী। উঠে আগেই পিছনের খোলা জায়গাটায় চলে গেলাম। দুধারে ছোট বড় বাড়ি যেন নিপুণ তুলিতে আঁকা। জলটা আসলে বিস্তৃত খাঁড়ির মত। নানা পাখি আসে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জলের পাশে পাশে বেশ কিছু প্রাচীন উইন্ডমিল চোখে পড়ল। এগুলো এখন কার্যকরী নয় তবে পর্যটকদের নজর কাড়তে এরা অনন্য।


 



স্বপ্নের ফুল


ছোট খাঁড়ি পেরিয়ে বিস্তৃত জলাশয়ে পড়ল আমাদের জলযান। সৌরেন্দ্র- সৌম্যজিৎ একটা গান শ্যুট করে নিল ওপেন ডেকে। সেই গান শুনে আপ্লুত ক্রুজের প্রবীণ মহিলা অ্যাটেনডেন্ট। তিনি আমাদের ছবি তুলে রাখলেন। নাহ, বেশিক্ষণ বাইরে থাকা গেল না। চড়া রোদেও কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় বাইরে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। তাই ভেতরে বসে গরম কফি আর অ্যাপেল পাই চেখে দেখা। দুপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল প্রকৃতিও যেন মন প্রাণ ঢেলে সাজিয়ে দিয়েছে চারপাশ।



দেড় ঘন্টা জ্লবিহার সেরে আবার বাসে চড়া। এবার গন্তব্য স্বপ্নের সেই বাগান। বাস গিয়ে দাঁড়ালো বিস্তৃত মাঠের এক পার্কিংয়ে। দূরে দেখতে পাচ্ছি লেখা কিউকেনহফ। গেট পেরিয়ে সামনেই চোখ আটকে গেল। ছোট্ট একটা জায়গায় একসঙ্গে নানা রঙের টিউলিপ ফুটে রয়েছে। সবুজের বুকে লাল হলুদ বেগুনি রঙের ফুল যেন এক মহার্ঘ কার্পেট বুনে রেখেছে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই ফুলের মেলা। পায়ে হাঁটা পথের দু'ধারে কেয়ারি করে সাজানো নানা রঙের টিউলিপ আর লিলি। কোন দিক ছেড়ে কোন দিকে যাব, যেন দিশেহারা লাগছিল। কী অপূর্ব তাদের গড়ন, কী নয়নাভিরাম তার রঙের ছটা। মাঝে মাঝে জলের ধারা বয়ে চলেছে। তার ওপর দিয়ে ছোট ছোট হাঁটার পথ। উঁচু নিচু করে নানা পথ নানা দিকে এগিয়ে গেছে। মাঝে এক প্রাচীন উইন্ড মিল। তার ওপরে উঠে উঁচু থেকে বাগান দেখার সুযোগ রয়েছে। এর উল্টোদিকেই সেই দিগন্ত বিস্তৃত টিউলিপ ক্ষেত হলুদ ফুলে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। ওই তো আমার স্বপ্নে দেখা সেই বাগান। ছোটবেলার স্বপ্নকে বাস্তবে মাটিতে ছুঁয়ে দেখা। দেখতে দেখতে ঘন নীল আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে বৃষ্টি নামল। নাহ, ঠিক বৃষ্টির মত কিন্তু গা ভিজিয়ে দিচ্ছে না তো। চেয়ে দেখি খইয়ের মত দানা দানা বরফ পড়ছে। একি কান্ড! এ যেন মেঘ না চাইতে জল। সে সময় বাগানে উপস্থিত এত মানুষ কেউই বৃষ্টিতে ছাওয়া খুঁজছে না। সবাই তখন বরফ হাতে শৈশব উপভোগ করছে। মিনিট পাঁচেকে চারপাশ সাদা হয়ে গেল। তারপরে আবার মেঘ কেটে সূয্যি মামা দেখা দিলেন।


ওখান থেকে আমরা বেশ কিছু স্মারক সংগ্রহ করলাম। কিন্তু তখনও দেখা বাকি রয়েছে। বাগানের মাঝে একটা বিশাল ঢাকা জায়গায় নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় যেন টিউলিপের ক্যাটালগ করা হয়েছে। যত ধরনের টিউলিপ এবং লিলি কালচার করে জন্মায় সব ধরনের ফুল এই ছাউনির নিচে একসঙ্গে দেখা যায়। নানা রঙের ফুলের ছবি তুলতে তুলতে আমরা প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এবার ফিরতে হবে। ফেরার বাসটা আবার দুতলা। এবার খানিক ওপর থেকে কান্ট্রি সাইড দেখতে দেখতে শহরে ফিরে এলাম। প্রবল খিদে পেয়েছে। সঙ্গে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। গরম গরম ডোনার দিয়ে পেট ভরিয়ে এবার একটু শপিং করে নিতে হবে। বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসছে। কয়েকটা স্টোরে ঘুরে বেশ কিছু চকোলেট কেনা হল। আজ অবশ্য হারবার লাগোয়া এক পাঁচতারা হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। ১৪ তলায় জানলার পর্দা সরাতেই  কাঁচের ওপারে রাতের অ্যামস্টারডাম ও হারবার যেন মোহময়ী রূপসী নারীর মতো চিরযৌবনা।



চলবে ...


আরও পড়ুন :  বিঠোভেনের শহর, রামধনু রং, ঘুমের ওপারে নতুন দেশ...


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামেও। যুক্ত হোন


https://t.me/abpanandaofficial