১৭ মার্চ, ২০২৩
সকাল সকাল ঘুম ভাঙল। আকাশে মেঘ, হালকা বৃষ্টি পড়ছে। লন্ডনে গোটা দিন বৃষ্টিহীন খুব কমই পাওয়া যায়। ছাতা সঙ্গেই ছিল। সকালে খানিক জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য ব্রিটিশ মিউজ়িয়াম। আগেই বলেছি লন্ডন শহরে ঘোরার সবচেয়ে ভাল উপায় হল আন্ডারগ্রাউন্ড টিউব। নেমে খানিক হেঁটে পৌঁছে গেলাম। লম্বা লাইন বাইরে পর্যন্ত। তখনও বৃষ্টি পড়ছে। ভিতরে পৌঁছতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। চারদিকে প্রাসাদোপম বাড়ি। মাঝের বিশাল উঠোন কাঁচে ঢাকা। বিশ্বের নানা প্রান্তের নানা ইতিহাসকে তারা ধরে রেখেছে। এ যেন ঘড়ির কাঁটার উলটো পথে হাঁটা। আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ার গ্যালারি, যার একটা বড় অংশে ভারতের ইতিহাস ধরে রাখা আছে। আর পাঁচটা জাদুঘরের মতো প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি, বিষ্ণুমূর্তি তো রয়েইছে, সঙ্গে প্রাচীন ছবির সংগ্রহ চোখ টানার মত।
প্রাচীন ও মধ্যযুগ পেরিয়ে সমসাময়িক সময়কেও ভবিষ্যতের জন্য ধরে রাখার নিরন্তর প্রয়াস প্রশংসা করার মত। যামিনী রায়ের ছবি থেকে পন্ডিত রবিশঙ্করের সেতার, গুরু দত্ত’র পাসপোর্ট থেকে সত্যজিৎ রায়ের আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘার টাইটেল কার্ড তারই নমুনা মাত্র। তাদের সংগ্রহে রয়েছে বাংলায় ছাপা বেশ কিছু প্রাচীন বই। আর উল্লেখ করতেই হয় এক কালী মূর্তি। মাটির তৈরি বাংলার এই কালী মূর্তি উচ্চতায় দীর্ঘ না হলেও মনে গভীর রেখাপাত করে যায়।
আমাদের আকর্ষণের আরও একটা জায়গা ছিল মিশর গ্যালারি। যে পাথর খোদাই দেখে হায়রোগ্লিফিক ভাষা উদ্ধার করা হয়েছিল তার সামনে দাঁড়ালে পৃথিবীর ইতিহাসের সংজ্ঞা বদলে যায়। মিশর গ্যালারিতে রয়েছে বেশ কিছু মমি। গ্রিক গ্যালারির আকর্ষণ পার্থেনন মন্দিরের অবশিষ্টাংশ। রোমান গ্যালারির নানা মূর্তি চোখ আটকে রাখে। আফ্রিকান গ্যালারি আদিম সভ্যতার মুখোমুখি দাঁড় করায় আমাদের। ব্রিটিশ মিউজ়িয়ামের যে ব্যাপ্তি একটা গোটা দিনও সবটা ঘুরে দেখার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তবে যেটা বারবার মনে রেখাপাত করে তা হল ইতিহাসকে ধরে রাখা এবং তা মানুষের কাছে কত সুন্দর করে তুলে ধরা যায়। এবং তার অন্যতম নিদর্শন এই ব্রিটিশ মিউজিয়াম।
বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে যখন বেরোলাম তখন আকাশ একেবারে পরিষ্কার। শেষ দুপুরের ঝকঝকে রোদে হাঁটা দিলাম শহরের প্রাণকেন্দ্র ট্রাফালগার স্কয়্যারের দিকে। মাঝে এক রেস্তোঁরায় খানিক খেয়ে নেওয়া। পথে পড়ল হ্যারি পটার মিউজিয়াম। সাম্প্রতিককালে তার মত জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র আর দ্বিতীয় জন্ম নেয়নি।
লন্ডন শহরের মাঝে ট্রাফালগার স্কয়্যার। বিকেলের পড়ন্ত রোদে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ যেন এক উঠোনে মিলিত হয়েছে। যে যার নিজের মতো আনন্দ করছে। কেউ কেউ মস্ত বড় সিংহের পিঠে চাপার চেষ্টা করছে। দূরে বিকেলের রোদে ক্লক টাওয়ার ঝলমল করছে সোনার মতো। কেউ আবার গান করছে। তা ঘিরে কিছু মানুষের ভিড়। এত মানুষের আনন্দ উচ্ছ্বাস যেন দু'ধারের দুই ফোয়ারা হয়ে ঝরে পড়ছে। কথা প্রসঙ্গে একটা কথা বলতেই হয়, শুধু লন্ডন শহর নয় গোটা ইংল্যান্ড জুড়ে বহু মানুষকে দেখলাম রাস্তার ধারে বা পার্কে কেউ স্যাক্সোফোন বাজাচ্ছেন কেউ আবার গিটার নিয়ে গান করছেন। কেউ উঠতি যুবক, আবার কেউ প্রৌঢ়। এরা সবাই সুরে সুরে দেশটাকে ভরিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, এভাবে শিল্পীদের হাত পাততে হচ্ছে। তার উত্তরে বলা যায়, এরা কেউ চুরি করছেন না, লোক ঠকাচ্ছেন না বা রাজনৈতিক দাদা-দিদির পায়ে নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছেন না। নিজেদের শিল্প দিয়ে মানুষকে খুশি করে উপার্জন করছেন। আমার স্যালুট এইসব শিল্পীদের।
এবার হাঁটা দিলাম বাকিংহাম প্যালেসের পথে। ট্রাফালগার স্কয়্যার থেকে বাকিংহাম প্যালেসের পথ অনেকটা আমাদের বিবাদীবাগের মত। সব বাড়িগুলোই বেশ পুরনো। তাদের কোনও কোনটা আবার ২০০-৩০০ বছরেরও রয়েছে। বেশ কিছু রাষ্ট্রদূতের অফিস এখানে। যেসব বাড়িতে বিশিষ্টজনেরা থেকেছেন তাদের গায়ে ব্লু প্লাক লাগানো রয়েছে। ঐতিহ্যকে কীভাবে সমসাময়িক করে ধরে রাখতে হয় ব্রিটিশদের কাছে শেখার আছে। কলকাতায় ব্রিটিশ আমলে তৈরি একের পর এক বাড়ি যখন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বা শরিকি বিবাদে ভগ্নপ্রায় হয়ে ক্রমে প্রমোটারদের গ্রাসে চলে যাচ্ছে তখন এদেশে পা রাখলে বোঝা যায় শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, নাগরিকরা কতটা ঐতিহ্য সচেতন হলে তবেই এভাবে দৈনন্দিন সংরক্ষণ সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। ডালহৌসি পাড়ার এক একটা পুরনো বাড়ি ভেঙে যখন কাঁচের বাক্স তৈরি হতে দেখি তখন বারবার নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর একটা উক্তি মনে পড়ে যায়, “বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি”।
সূর্য তখন সবে অস্তপাটে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে । তখনও আকাশে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট দিনের আলোয় বাকিংহাম প্যালেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রথম থেকেই এ বাড়ি ব্রিটিশ রাজ পরিবারের মূল প্রাসাদ ছিল না। রাজা তৃতীয় জর্জ রানির জন্য এই বাড়িটি অধিগ্রহণ করেন। তখন এর নাম ছিল কুইনস প্যালেস। পরে রানি ভিক্টোরিয়ার আমলে এটি রাজ পরিবারের লন্ডনের প্রধান আবাস হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে এই বাড়িটির এক একটি অংশ তৈরি হয়েছে। আজ ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সমস্ত কাজকর্ম এখান থেকেই পরিচালিত হয়। কুইন এলিজাবেথ গত হয়েছেন কয়েক মাস আগে। তখনও চার্লসের রাজ্যাভিষেক হয়নি। তবে ইংল্যান্ডেশ্বরীর প্রধান গড় হিসেবে মনে মনে কল্পনায় যে ছবিটা আঁকা ছিল এবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তা যেন কিছুটা হোঁচট খেল। বাড়িটা না স্থাপত্যের দিক থেকে চোখ টেনে নেওয়ার মত, না বিশালতায় স্তম্ভিত করার মত। বাইরে দাঁড়িয়ে এ যুগের নিয়মমাফিক কয়েকটা ছবি তোলা হল।
অন্ধকার নেমে এসেছে। ঠান্ডাও বেশ কাঁপুনি ধরাচ্ছে যখন, আমাদের গন্তব্য হার ম্যাজেস্টিস থিয়েটার। লন্ডনে এসে থিয়েটার দেখার পরিকল্পনা কলকাতাতেই করা ছিল। সৌম্যজিতের মুখে বহুবার শুনেছি এর প্রশংসা। তাই কলকাতায় বসেই টিকিট কাটা হয়েছিল। ১৮৯৭ সালে হার ম্যাজেস্টিস থিয়েটার তৈরি হয়। ১৯৮৬ থেকে অ্যান্ড্রু লয়েড ওয়েবারের ‘দ্য ফ্যান্টম অফ দ্য অপেরা’ এখানে একটানা অভিনীত হচ্ছে। (আমরা দেশে ফেরার পর এর শেষ শো হয়ে গেল)। সমাজ এবং সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক সে গান, কবিতা, নাটক হোক বা স্থাপত্য, ক্রীড়া বা রন্ধনশৈলি। এরা সবাই সমাজের সঙ্গে বহমান নদীর মত। সেই নদীতে যখন ঐতিহ্যের পলি পড়ে তখন তা নাব্যতা হারায়। তার গতি ক্রমশ স্লথ হয়ে পড়ে। সমাজের সঙ্গে সে আর পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারে না। তখনই সমাজের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। আজ প্রযুক্তি যখন হাতের মুঠোয়, প্রায় প্রতিমুহূর্তে বদলে যাচ্ছে সবকিছু, তখন ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে সেই সংস্কৃতির মুমূর্ষ হয়ে পড়া ঠেকায় কে !
‘আমাদের বাংলার থিয়েটার’ বলতে শ্লাঘায় আজও যাঁদের বুকের জামা আঁট হয়ে বসে তাঁদের একবার অন্তত ইউরোপিয়ান থিয়েটার বা মিউজিক্যাল দেখা উচিত। আধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মঞ্চাভিনয় কোন উচ্চতায় পৌঁছতে পারে, এখানে এসে স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হত। মঞ্চসজ্জা, আলো, শব্দ, গান, অভিনয় সবমিলিয়ে কয়েকশো মানুষের নিরন্তর পরিশ্রমের ফসল একটা থিয়েটার। তবেই তো প্রায় ৪০ বছর ধরে চলার পরেও প্রতিটা শো হাউসফুল। যাঁরা বাংলার থিয়েটার ভালোবাসেন, আগামী দিনে থিয়েটারকে যুগের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তাঁদের জীবনে একবার অন্তত এমন একটি শো চাক্ষুষ করা উচিত। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দৃষ্টিভঙ্গির বদল আনবে। বাংলার নাট্য সংস্কৃতি নাব্যতা পাবে। (বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : মন্তব্য একান্ত ব্যক্তিগত। তবে কেউ যদি সত্যিই বিদেশে গিয়ে এধরনের শো চাক্ষুষ করতে চান তবে প্লেনে ওঠার আগে অনলাইনে টিকিট কেটে রাখবেন)
কার্টেন কল শেষেও হাততালি থামছে না। চারতলা জুড়ে হাজার খানেক দর্শক মন্ত্রমুগ্ধর মত হাততালি দিয়ে চলেছেন। পথে যখন নামলাম ঘড়িতে প্রায় রাত সাড়ে দশটা। আকাশ থেকে ফোঁটা ফোঁটা আনন্দধারা নেমে আসছে। পিকাডেলি স্কয়্যারের মাঝে বেশ কিছু মানুষ মহানন্দে উদ্দাম গান গাইছেন। আনন্দ যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে সেখান থেকেও। আমরা বাড়ি ফেরার টিউব ধরলাম।
আরও পড়ুন : ফোন চুরি গেল লন্ডনে, ফেরতও এল পনের মিনিটে !
চলবে...