কলকাতা : একটা ফোন কল। অ্যাকাউন্ট থেকে হু হু করে গায়েব হয়ে যাচ্ছে টাকা। রিটায়ারমেন্টের পর মেয়ের পড়াশোনার জন্য ৪ লাখ টাকা তুলে রেখেছিলেন রীণা দেবী। অথচ, একটি বেড়ানোর ফ্রি অফারের টোপে খুইয়ে ফেললেন সব টাকা। ৯০ এর উপেনবাবু। তিল তিল করে জমানো জীবনের শেষ সম্বলটুকুও খুইয়েছেন অনলাইনে কেনাকাটা করতে গিয়ে। জিনিস বদলাতে গিয়ে খপ্পরে পড়ে যান এক জালিয়াতি সংস্থার। ব্যস বাকি জীবনটা কী করে কাটাবেন, সেই চিন্তাতেই এখন তাঁর কাটছে দিন। আর এই সব খবর খবরের কাগজ আর টিভিতে দেখে ঘুম উড়ে গিয়েছে গৃহবধূ দীপালির। বছর দুই আগেও এটিএম কার্ড ব্যবহার করতেই ভয় পেতেন তিনি। করোনা দশা আর লকডাউনে বাধ্য হয়েই মোবাইল অ্যাপে কেনাকাটা অভ্যেস করে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু এই সব খবরগুলো শোনার পর থেকেই অনলাইন শপিং নিয়ে ভয়ঙ্কর ভীতি জন্মেছে তাঁর।


এর উপর আবার খাঁড়ার ঘা পেগাসাসের খবর। জানা গেছে, আপনি হয়ত ঘরে বসে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছেন। পাশে টেবিলে রাখা আছে মোবাইল ফোন। আপনি ভাবছেন ঘরে কেবল আপনারা দু’জন। কিন্তু, বাস্তবে আপনাদের কথা অজান্তেই চলে যাচ্ছে অন্যের কাছে। কীভাবে জানেন? টেবিলে পড়ে থাকা ওই মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই। সেজন্য আপনার ফোনে শুধু একটা স্পাইওয়্যার ঢুকিয়ে দিতে হবে। সব মিলিয়ে দীপালির মতো অনেকেরই ঘুম উড়েছে। অনলাইন শপিং নিয়ে এক ভয়ঙ্কর ফোবিয়া দেখা দিয়েছে। কনসাল্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সৃষ্টি সাহার সঙ্গে আলোচনায় উঠে এল বিস্তারিত তথ্য। 

সৃষ্টি জানালেন, এই সাইবার ইনসিকিউরিটি সারা বিশ্বের বিভিন্নরকম ভীতির মধ্যে প্রথম পাঁচের মধ্যেই পড়ে। অষ্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণায় উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মানুষ যেমন আরশোলা, সাপ, উচ্চতা নিয়ে ভয় পায়, তেমনই বড় সংখ্যক মানুষ ভয় পাচ্ছেন হ্যাকড হয়ে যাওয়ার। একেই বলে সাইবার ইনসিকিউরিটি বা হ্যাকার ফোবিয়া। তাতেই বোঝা যাচ্ছে, ২১ শতকে আমরা যত ডিজিট্যাল মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল হচ্ছি, ততই আমাদের মাথায় চেপে বসছে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। তবে সেটা যদি শুধু হাল্কা দ্বিধাতেই সীমাবদ্ধ হত, তবে হয়ত চিন্তার কিছু থাকত না। কিন্তু এর শিকড় আরও গভীতে বিছিয়ে চলেছে। ভয় হচ্ছে - 

- আপনি ফোনে কথাও বলছেন না, তখন সেই  অবস্থাতেও কি আপনি হ্যাকারদের নজরে ? 
- আপনার ফোন মেমরিতে সেভ করে রাখা তথ্যও কি চুরি হয়ে যেতে পারে ? 
- আপনি ফেসবুকে কোনও মজার গেম বা কনটেস্টে পার্টিসিপোট করতে গিয়েও কী ফতুর হয়ে যেতে পারেন ?
- কোনও আকর্ষণীয় অফার আপনার মোবাইলে এলে কি আপনি সেই লিঙ্কে ক্লিক করবেন ? 
- আপনার ডেবিট কার্ডের মারফত কি ফোন থেকে কেনাকাটা নিরাপদ ? 
- মোবাইলে কোনও ব্যাঙ্কের অ্যাপ রাখা নিরাপদ তো? 


এই প্রশ্নগুলি মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তার থেকেও ভয় ধরাচ্ছে ব্যক্তিগত তথ্য হাতছাড়া হওয়ার ভয়। তাই করোনাকালে যে কাজগুলি চোখ বুজে অনলাইনে করাই নিরাপদ, সেগুলোও অফলাইনে করতে উদ্যত হচ্ছেন কেউ কেউ। করোনা সতর্কতা উপেক্ষা করেই ব্যাঙ্কের লাইনে ভিড় বাড়াচ্ছেন। এতে করে নিজের বিপদই ডেকে আনছেন। কিন্তু কোনটা আশঙ্কা আর কোনটা ফোবিয়া ? 



  • অনলাইনে কাজ করতে কেউ বললেই কি আপনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন? কিছুতেই ভরসা করে ডেবিট কার্ডটা ব্যাগের বাইরে বের করতে পারছেন না ?

  • অনলাইনে কাজ করা এড়ানোর জন্য আপনি কি রোদ-জলে পুড়ে বাজারে ছুটছেন?

  • অনলাইন ট্রানস্যাকশন করার পরও কি আপনি খালি ভেবেই চলেছেন, আপনার সব টাকা পয়সা হাতছাড়া হয়ে গেল  বলে!

  • আপনি একটা কিছু অনলাইনে কেনাকাটা করার পর থেকেই এত ভয় পেয়ে আছেন যে অন্য কোনও কাজ করতে পারছেন না ? 


যদি আপনি এতটাই ভীত হয়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চিত আপনি ফোবিয়ায় আক্রান্ত। এর থেকে আপনাকে বেরিয়ে আসতেই হবে। যে কোনও ভীতিকে জয় করারই বেশ কিছু উপায় আছে। যেমন, 



  • আপনি অনলাইন হ্যাকিং নিয়ে সাইবার বিশেষজ্ঞদের আর্টিকল পড়ুন।

  • এই বিষয়ে অনেক তথ্য আজকাল ইউটিউবে পাওয়া যায়।

  • প্রয়োজনে আপনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা যাঁরা অনলাইন কেনাকাটায় স্বচ্ছন্দ, তাদের সঙ্গে কথা বলুন

  • কোনও নির্দিষ্ট প্রশ্ন থাকলে সাইবার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ই-মেলে যোগাযোগ করতে পারেন। 

  • কোনও অচেনা লিঙ্ক বা আপনার অপরিচিত অ্যাপ হঠাত্ করে ডাউনলোড করবেন না। 

  • অপরিচিত কারও কথায় কোনও লিঙ্কে গিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করবেন না।

  • অচেনা অ্যাপ ফোনে ডাউনলোড করবেন না।

  • হঠাত্ করে কিছু লাভ করার লোভে পা দেবেন না। গাড়ি, বাড়ি, ট্যুর নিখরচায় কেউ কাউকে দেয় না, মনে রাখবেন। 

  • যদি ভয়টা এতটাই মাথায় চেপে বসে যে, আপনি অতি প্রয়োজনেও অনলাইনে কিছু করতে ভয় পাচ্ছেন, তবে মনোবিদের পরামর্শ নিন। 

    ফোনে আসা কোনও লিঙ্কে ক্লিক নয়, একটা মিসকলের মাধ্যমেই ফোনে ঢুকিয়ে দেওয়া যেতে পারে স্পাইওয়্যার পেগাসাস! এতটা ভয়ঙ্কর হওয়ার জন্যই একে ‘জিরো ক্লিক অ্যাটাক’ ও বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এতে সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার এতটাও প্রয়োজন নেই। আর কোনও আতঙ্ক নিয়ে তো সব কাজ বন্ধ করে দেওয়া যায় না ! মনো রাখতে হবে, হোয়াটসঅ্যাপ , ফেসবুকে ছড়ানো যে কোনও খবরকেই সঠিক বলে আতঙ্কিত হবেন না। এছাড়া যে কোনও ফোবিয়া কাটাতেই হালকা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ, কাজকর্মে ব্যস্ত থাকা দারণ কাজ করে। তবে কোনও ভয় যদি মাত্রাতিরিক্ত হয়, তবে চিকিত্সকের সাহায্য নিতেই হবে।
     
    পরামর্শ দাতা -


    Srishti Saha

    Consultant Clinical Psychologist

    Visiting Consultant at 

    Fortis Hospitals, Anandapur,

    Fortis Hospital & Kidney Institute and

    Peerless Hospital,