কলকাতা: করোনার আতঙ্ক এখনও কমেনি। সুস্থতার হার বাড়লেও, স্বস্তিতে দেশ, এই কথা এখনও বলা যাচ্ছে না। ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার আশঙ্কা ।চিকিত্সকরা ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছেন, ঠিকমতো নিয়ম না মানলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই হয়তো দেশে ভয়ঙ্কর ভাবে আঘাত হানবে করোনার থার্ড ওয়েভ। দ্বিতীয় ঢেউ, দেখিয়ে দিয়েছে ২০২০ থেকে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই সত্বেও আমরা এখনও কতটা অসহায় ! ২০২১-এ ভারতে দেখেছে করোনায় মৃত্যুমিছিল, অক্সিজেন নিয়ে হাহাকার ও বেডসঙ্কট। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি অসুখ কোভিডের পরেও চোখ রাঙানি দিয়েছে। করোনা থেকে সেরে ওঠার পরেও বিভিন্ন রকম ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। কখনও ফুসফুসের কঠিন অসুখে, কখনও হার্টের সমস্যায়, কখনও বা কিডনির গুরুতর অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। এখানেই শেষ নয় করোনার পরে শরীরে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস, হোয়াইট ফাঙ্গাসের আক্রমণও ঘটছে। করোনার সময় ঘ্রাণ ও স্বাদের অনুভূতি বেশ কিছুদিনের জন্য চলে যায়। এই অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, করোনা সেরে যাওয়ার পরও, তাদের অনুভূতি ফিরতে সময় লেগেছে আরও বেশ কিছুদিন। তবে শুধু স্বাদ-গন্ধ নয় করোনা পরবর্তীকালে শ্রবণশক্তিতেও সমস্যাও দেখা গেছে। শহরের নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞদের কাছে করোনা হওয়ার পর শ্রবণক্ষমতা হারিয়েও এসেছেন কেউ কেউ।
এই বিষয়ে এবিপি লাইভ এর সঙ্গে আলোচনা করলেন, বেলভিউ ক্লিনিকের সঙ্গে যুক্ত কনসালটেন্ট ইএনটি ও স্লিপ অ্যাপনিয়া সার্জেন ডা. দীপঙ্কর দত্ত । চিকিত্সক জানালেন, যত সংখ্যক করোনা সংক্রমণ হয়েছে, সেই তুলনায় শ্রবণশক্তি চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। তবে সংখ্যাটা একেবারে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার মতোও নয়। তাঁর কাছে হঠাৎ শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়ে ২০২০ সাল থেকে বেশ কয়েকজন রোগী এসেছেন। তাঁদের শ্রবণ ক্ষমতা হারানোর অন্যরকম কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি । শুধু দেখা গেছে, তাঁরা সদ্য করোনা থেকে সেরে উঠেছেন। চিকিৎসক জানালেন, করোনা পরবর্তীতে শ্রবণশক্তি চলে যাওয়ার ঘটনাটি ধীরে ধীরে ঘটে না অর্থাৎ আস্তে আস্তে কানে কম শুনতে শুনতে, একদিন শুনতে পাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো হয় না। হঠাৎ একদিন কানে শুনতে পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কেন এই ঘটনা আন্দাজ করতে পারেন না রোগী।
দেখা যাচ্ছে, তাঁদের শরীরে অন্য কোনও ব্যাধি অর্থাৎ ডায়াবেটিস, ইসকেমিয়া (ischemia), হারপিস, চিকেন পক্স, এইচআইভি- র মত কোনও কোমর্বিডিটি, যার জন্য হঠাৎ শ্রবণক্ষমতা চলে যেতে পারে, তা নেই। এমনকী এমন কোনও ওষুধও তাঁরা নিয়মিত খান না, যার ফলে শ্রবণক্ষমতা চলে যেতে পারে। একমাত্র দেখা গেছে, এঁরা সদ্যই করোনা থেকে সেরে উঠেছেন।
স্বাভাবিকভাবেই, কোনও রোগী যখন এই ধরনের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন, তখন হঠাৎ শ্রবণ ক্ষমতা হারানোর পিছনে কী কারণ হতে পারে, তা খতিয়ে দেখেন ডাক্তাররা। কিন্তু এক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও শ্রবণশক্তি চলে যাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাননি তাঁরা। শুধুমাত্র দেখা গেছে, তাঁরা করোনা আক্রান্ত ছিলেন। নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডা. দীপঙ্কর দত্ত জানান, প্রথম এই ধরনের সমস্যার কথা, গত বছর অক্টোবর মাসে একটি ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়। তারপরেই বেশ কয়েকজন রোগী পরপর আসেন তাঁর কাছেও।
এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কী শ্রবণ ক্ষমতা আর ফিরে পাওয়া যায় না?
চিকিৎসক জানান, সবকিছুর জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। অকারণ দেরি করে ফেললে পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যায়। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে। দিনের দিন সঙ্গে সঙ্গে এলে সবথেকে ভাল। সেক্ষেত্রে নিউরোভিটামিন ইঞ্জেকশন, স্টেরয়েড ইত্যাদি ব্যবহার করে রোগীকে শ্রবণশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। অকারণ দেরি করে ফেললে শ্রবণ ক্ষমতা ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
তবে এরই মধ্যে একটি আশার কথা শোনালেন চিকিৎসক। দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর এই ধরনের রোগীর সংখ্যা কিছুটা হলেও কমেছে । বরং কোভিড পরবর্তী ব্ল্যাক ফাংগাস বা মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এখন বেশি ।
কেন হঠাৎ শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনা ঘটছে করোনার পরে ?
এর কোনও নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া-না-গেলেও একটি বিষয় ভাবাচ্ছে ডাক্তারদের। তা হল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন এর ব্যবহার। করোনার প্রথম কালে যাঁদের হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন দেওয়া হয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে শ্রবণ ক্ষমতা হারানোর একটি সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিছু ওটোটক্সিক ওষুধ (Ototoxic drugs) আছে, যা শ্রবণ ক্ষমতার খুবই ক্ষতি করে। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন সেরকমই একটি ওষুধ। এবার দ্বিতীয় ঢেউতে এই ওষুধটি প্রায় ব্যবহারই হয়নি, সেটাই বাঁচোয়া।
ইতিমধ্যেই করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ে সাবধানবাণী শুনিয়েছেন দিল্লি এইমস-এর অধিকর্তা রণদীপ গুলেরিয়া।
তাঁর দাবি, করোনাবিধি যদি ঠিকঠাক না মানা হয় এবং ভিড় নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে আগামী ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে ভারতে করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে। তাই সতর্ক থাকুন, আতঙ্কিত নয়। মেনে চলুন চিকিত্সকের পরামর্শ।