করোনার প্রথম ঢেউয়ের থেকে দ্বিতীয় ঢেউ অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ভাবে দেখা দিয়েছে। রোজই নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে সংক্রমিতের সংখ্যা। ২০২০ তে শিশুদের ক্ষেত্রে ততটা ভয়ঙ্কর হিসেবে দেখা দেয়নি এই ভাইরাস । করোনার প্রথম ঢেউতে ভারতে শিশুরা আক্রান্ত হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থেকেছে উপসর্গহীন বা অ্যাসিম্পটোম্যাটিক। এবছর ভাইরাসের নতুন স্ট্রেন শিশুদেরও পর্যুদস্ত করছে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ১ মার্চ থেকে ১ এপ্রিলের মধ্যে দেশের সবচেয়ে করোনা বিধ্বস্ত ৫টি রাজ্যে প্রায় ৭৯ হাজার শিশু করোনা আক্রান্ত হয়েছে। প্রথম ঢেউয়ে সংখ্যাটা এর ধারেকাছেও ছিল না। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ৫ মে পর্যন্ত রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে যতজনের মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে ১৫ বছর পর্যন্ত বয়সীদের মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক শূন্য নয় শতাংশ। উদ্বেগ বাড়ছে মা-বাবার মধ্যে।
করোনায় শিশুদের উপসর্গ -
করোনা আক্রান্ত হয়ে বাচ্চাদের মধ্যে অনেক উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা বিপদজনকও হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে কোথায় কখন কী চিকিৎসা পাওয়া যাবে তা নিয়ে একটা সম্যক ধারণা সকলের তৈরি হলেও, বাড়ির শিশুটি আক্রান্ত হলে স্বাভাবিক ভাবেই সকলে দিশেহারা হয়ে পড়েন। যদি পরিবারের শিশুটি পজিটিভ হয়ে পড়ে, তখন কী করবেন, এবিপি লাইভ-কে জানালেন ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথের চিকিৎসক ( Prof and head of pediatrics) ডা. জয়দেব রায়।
কী ওষুধ দেওয়া যায় :
- বড়রা করোনা হলে ওষুধ খেয়ে থাকেন, সেই ওষুধ বাচ্চাদের কাজে দেয় না।
- করোনা আক্রান্ত হলে প্রাপ্তবয়স্করা যেমন আইসোলেশনে থাকেন, তেমনই বাচ্চাদের আলাদাই রাখতে হবে।
- সারাদিনে বারবার বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করুন
- পালস অক্সিমিটার এ অক্সিজেন স্যাচুরেশন পরীক্ষা করুন
- তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর বেশি উঠলে প্যারাসিটামল দিতে পারেন ১০-১৫ mg / Kg/ dose হিসেবে
- প্রচুর জল খাওয়ান শিশুকে
- ফলের রসও এই সময় খুব উপকারী।
- বাচ্চাকে ভিটামিন সি, জিংক, ইত্যাদি ওষুধ দেওয়া যেতে পারে।
শিশুদের আইসোলেশনের শর্ত
- এখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, মা-বাবা আক্রান্ত হলে বাচ্চাদের শরীরে করোনাভাইরাস ঢুকে পড়ছে। ফলে শিশু পজিটিভ হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যদি উপসর্গ নাও থাকে তাহলেও পরীক্ষা করানো দরকার।
- rt-pcr টেস্টের রিপোর্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞকে পাঠান। জেনে নিন সেই মুহূর্তে কী করণীয়।
- যদি শিশু পজিটিভ অথচ মা-বাবা নেগেটিভ হন : অনেক সময় হউজিং কমপ্লেক্সে বাচ্চারা একসঙ্গে খেলাধুলো করে। সেখন থেকে যদি শুধু সেই সংক্রমিত হয়, তবে বাচ্চাকে আইসোলেশনে রাখতে হবে। কিন্তু যত্ন নেওয়ার জন্য অভিভাবকদের একজনকে তার কাছে থাকতেই হবে। তখন বাচ্চাকে পরিয়ে রাখতে হবে মাস্ক। অভিভাবককেও পিপিই পরে , মাস্ক পরে তার কাছে যেতে হবে।
- যদি মা-বাবা পজিটিভ অথচ বাচ্চা নেগেটিভ হয়, উপায় না থাকলে বাচ্চাকে নিজের কাছে রাখতেই হবে। কিন্তু সবসময় মাস্ক পরে বাচ্চার কাছে থাকতে হবে । স্যানিটাইজেশন করতে হবে বারবার। বাচ্চার সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখেই যত্ন করার চেষ্টা করতে হবে।
- শিশু সদ্যোজাত হলে মায়ের কাছেই রাখুন তাকে। যদি না, মা অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো অবস্থায় থাকেন। মাতৃদুগ্ধও পান করতে পারে। মা-বাবা করোনা আক্রান্ত হলে বাচ্চার টেস্ট না করেই তাকে দাদু দিদা বা দাদু ঠাকুমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন না। আগে দেখুন বাচ্চাটি পজিটিভ কিনা, তাহলে বাচ্চাকে মা-বাবার কাছেই রাখতে হবে। টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ হলে তাকে দাদু-দিদা বা অন্য কোনও নিকট আত্মীয়ের কাছে পাঠানোর কথা ভাবা যেতে পারে। বাচ্চা যদি উপসর্গহীন হয় তাহলেও তার মাধ্যমে অন্যরা সংক্রমিত হতে পারে । তাই টেস্ট না করে তাকে অন্যদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া অনুচিত।
শিশুদের করোনা উপসর্গ -
- জ্বর
- সর্দি-কাশি
- বমি
- পেট খারাপ
- গলায় ব্যথা
- গায়ে ফুসকুড়ি
- চোখ লাল হওয়া
- পুঁজ ছাড়া কনজাঙ্কটিভাইসিস
- স্বাদ-গন্ধ না পাওয়া
এগুলি হল করোনার স্বাভাবিক উপসর্গ। চিকিৎসকদের পরামর্শ, কোনও শিশুর এই উপসর্গের একটিও দেখা দিলেই যেন সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
কোন ক্ষেত্রে বাচ্চার অবস্থা বিপদজনক?
- ৪-৫ দিনের বেশি জ্বর? তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন
- বাচ্চা কি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে একেবারেই? তবে চিন্তার বিষয়
- বাচ্চাটি যদি আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ে, তাহলে অবশ্যই চিন্তার কারণ রয়েছে
- অক্সিজেন স্যাচুরেশন যেন কখনোই ৯৫ নিচে না নামে। সেরকম দেখলে, অবশ্যই আপনার নিকটস্থ করোনা হাসপাতালে যান ।
- অনেক সময় বাচ্চাদের জ্বর হলে বাড়ির লোকেরা সাধারণ ভাইরাল ফিভার ভাবেন। এই মুহূর্তে সারা দেশ ও বাংলার যা পরিস্থিতি তাতে একদিন নষ্ট করা বিপদজনক হতে পারে । যদি দেখা যায় বাচ্চার জ্বর তিন দিন ধরে রয়েছে, তাহলে কোনওভাবেই দেরি না করে rt-pcr করান।
নতুন স্ট্রেনে শিশুদের বিপদ কতটা ?
এখনও পর্যন্ত ট্রেন্ড যা বলছে, তা হল বাচ্চারা হোম আইসোলেশনে মা-বাবার যত্নে থেকেই সুস্থ হয়ে উঠছে। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই শিশুরাও বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। ৬-১২ বছরের শিশুরা আক্রান্ত হয়েছে বেশি। কিছু উপসর্গ আবার রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক। পরিসংখ্যান বলছে, এখনও পর্যন্ত ৬০ থেকে ৭0 শতাংশ বাচ্চারাই উপসর্গহীন। আর যাদের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে এক থেকে দুই শতাংশের আইসিইউ ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন হতে পারে। করোনা আক্রান্ত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা ততটা না হলেও, ব্যবস্থা রয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া অন্যান্য যেখানে করোনা চিকিত্সা হয়, তাদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে বাচ্চাদের ভর্তি নেওয়ার বিষয়টি। ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথে করোনা আক্রান্ত শিশুদের চিকিত্সা হচ্ছে, তবে ভর্তি করার বিষয়ে সিদ্ধান্তটি এখনও কর্তৃপক্ষের ভাবনা - চিন্তার স্তরে।