পায়েল মজুমদার, কলকাতা: ছাত্রীকে নিয়ে আইসক্রিম খেতে বেরিয়েছেন দেবরাজ সহায়। হঠাৎ গোলমাল। রাস্তাঘাট, মানুষজন কোনও কিছুই চিনতে পারছেন না প্রৌঢ় ...ওদিকে মিশেল তাঁর 'টিচার'-এর অপেক্ষায়। 'ব্ল্যাক' ছবির এই দৃশ্য হয়তো অনেকের মনে থাকবে। সঙ্গে এও হয়তো মনে থাকবে যে, ওই ঘটনার বেশ কিছু বছর পর কী অবস্থায় 'টিচার'-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল মিশেল ম্যাকনেলের। অ্যালঝাইমার্সের (Alzheimer's Disease) দাপটে দেবরাজ সহায় তখন খেতেও ভুলে গিয়েছেন। পর্দার এই দৃশ্যকল্প হয়তো কাছ থেকে দেখেছেন অনেকে। তবে একাধিক গবেষণা বলছে, পুরুষদের (Men's Health) তুলনায় মহিলাদের (Women Suffer From Alzheimer's Disease) অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
অ্যালঝাইমার্স কী?
ডাক্তারি পরিভাষায় বললে, এটি এক ধরনের প্রোগ্রেসিভ নিউরোডিজেনারেটিভ ডিসঅর্ডার (Progressive Neurodegerative Disorder)। এই রোগে ধীরে ধীরে স্নায়ুকোষ এমন ভাবে নষ্ট হতে থাকে যার ফলে
--স্মৃতিশক্তি
---চিন্তাভাবনার করার ক্ষমতা
---সাধারণ কথাবার্তা বলার ক্ষমতা
---পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা
-সহ একাধিক ক্ষমতা ধাক্কা হতে থাকে। রোগটি বেড়ে গেল খাওয়াদাওয়া, কোনও কিছু গলাধঃকরণ করা, হাঁটাচলার মতো সাধারণ কাজ করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন আক্রান্ত ব্যক্তি। সাধারণত স্মৃতিশক্তির উপর প্রথম প্রভাব অ্যালঝাইমার্সের অন্যতম উপসর্গ। ডিমেনশিয়ার অন্যতম চেনা রূপ এটি।
বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজির, চিকিৎসক-অধ্যাপক, বিমানকান্তি রায় সহজ করে বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন। 'অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় মানুষ যে আলাদা, তার অনেকগুলো লক্ষণ রয়েছে। যেমন, আমরা চিন্তাভাবনা করতে পারি। মনে রাখতে পারি। হিসেব কষতে পারি। পরিকল্পনা করে সেই অনুযায়ী কোনও কাজ করতে পারি। আমাদের ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা রয়েছে। তা ছাড়া, মনের মধ্যে কোনও জায়গা সম্পর্কে একটা নিজস্ব মানচিত্রও তৈরি করে নিতে পারি। অ্যালঝাইমার্স আক্রান্ত হলে ভুলে যাওয়ার পাশাপাশি এই ক্ষমতাগুলিও ধাক্কা খেতে পারে।' কার্যত এক কথা বললেন, ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রির চিকিৎসক অধ্যাপক সুজিত সরখেল। তাঁর মতে, 'ভুলে যাওয়ার পাশাপাশি যখন পরিকল্পনা করার ক্ষমতা, সেই অনুযায়ী কোনও কাজ করার ক্ষমতা ধাক্কা খায়, তখনই সতর্ক হওয়া দরকার।'
সত্যিই মহিলাদের অ্যালঝাইমার্সের আশঙ্কা বেশি?
চিকিৎসক অধ্যাপক বিমানকান্তি রায়ের অভিজ্ঞতা তেমনই বলছে। তবে, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এই আশঙ্কা ঠিক কত গুণ বেশি, সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। একাধিক গবেষণা বলছে, মহিলাদের ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা অন্তত দ্বিগুণ। চিকিৎসক-অধ্যাপক সুজিত সরখেলের অভিজ্ঞতা অবশ্য এরকম নয়। তবে তাঁর মতে, 'আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এখানে বড় কারণ হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষদের কোনও অসুবিধা হলে তাঁরা চিকিৎসকের কাছে অনেক বেশি আসেন। মহিলারা ততটা খেয়াল করেন না। ফলে বহু ঘটনা হয়তো নজরে আসে না।'
কেন বেশি?
ডাক্তারদের একাংশ মনে করেন, কোনও একটি নয় এর পিছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে।
জিনগত কারণ...
এই বিষয়ে apolipoprotein E জিনের কথা বিশেষ ভাবে আলোচিত। এই জিনের একটি নির্দিষ্ট অ্যালেল, APOE-ε4,-কে অ্যালঝাইমার্সের অন্যতম কারণ বলে খুঁজে পেয়েছেন একাধিক গবেষক। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে APOE-ε4 এই অ্যালেল থাকার হার অনেক বেশি। তাই মহিলাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ায় আশঙ্কা পুরুষদের তুলনায় বেশি, ধারণা অনেকের। কার্যত একই কথা বললেন বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজির, চিকিৎসক-অধ্যাপক, বিমানকান্তি রায়।
অন্য একটি গবেষণা আবার MGMT নামে এই একটি নতুন জিনের কথা জানাচ্ছে যা মহিলাদের মধ্যে অ্যালঝাইমার্সের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। আসল ছবিটা হয়তো এত সরল নয়। ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত একটি পরিসংখ্য়ান অনুযায়ী, আমেরিকায় ৬৫ বছরের উপরে থাকা ৬০ লক্ষ অ্যালঝাইমার্স রোগীর দুই-তৃতীয়াংশই ছিলেন মহিলা। কেন মহিলারা এই রোগের প্রকোপে বেশি ভোগেন,জানতে গিয়ে ক্লিভল্যান্ডের Case Western Reserve University-র একদল গবেষক দেখেছিলেন, কারণ লুকিয়ে USP11 নামে একটি জিনে। তাঁদের বক্তব্য, এই জিন X ক্রোমোজোমে পাওয়া যায়। যেহেতু মেয়েদের ক্ষেত্রে, ২৩তম অর্থাৎ লিঙ্গনির্ধারক জোড়ায় দুটিই X ক্রোমোজোম থাকে, এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে একটি X এবং একটি Y ক্রোমোজোম থাকে, তাই মেয়েদের মধ্যে USP11-র দুটি প্রতিলিপি পাওয়া যায়। ফলে অ্যালঝাইমার্স হওয়ার আশঙ্কাও তাঁদের বেশি, ব্যাখ্যা এই গবেষকদের।
হরমোন...
চিকিৎসক-অধ্যাপক রায় বললেন, 'অ্যালজাইমার্স আটকাতে একটা বড় ভূমিকা থাকে ইস্ট্রোজেনের। কিন্তু মেনোপজ বা ঋতুবন্ধের পর ইস্ট্রোজেনের মাত্রা মহিলাদের দেহে কমে যায়। এটিও তাঁদের অ্যালঝাইমার্সে ভোগার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়ে থাকে।'
গঠনগত ফারাক...
সেরিব্রাল ব্লাড ফ্লো এবং অ্যামিলয়েড প্লাক সংক্রান্ত ফারাকও নারী-পুরুষের মধ্যে অ্যালঝাইমার্স আশঙ্কার বড় কারণ। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই অ্যামিলয়েড প্লাক আসলে একধরনের অস্বাভাবিক প্রোটিন জমতে থাকা। অ্যালঝাইমার্সের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এটি। মহিলাদের মধ্যে সাধারণভাবে এই অ্যামিলয়েড প্লাকের ঘনত্ব পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি দেখা যায়। গবেষণা আরও বলছে, বয়সকালে মহিলাদের সেরিব্রাল ব্লাড ফ্লো পুরুষদের তুলনায় কম হয় যা কিনা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমকা কমাতে পারে। এছাড়া জীবনযাপনের মধ্যেও একাধিক এমন ফ্যাক্টর থাকতে পারে যা মেয়েদের ক্ষেত্রে এই রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। 'সার্বিক ভাবে পুরুষদের তুলনায় মহিলারা পুষ্টির জোগানের নিরিখে পিছিয়ে। এতেও এই অসুখের সম্ভাবনা বাড়তে পারে। তা ছাড়া, যিনি যত বেশি বিভিন্ন ধরনের পরিবেশে মিশবেন, তাঁর তত এই রোগের ঝুঁকি কমে বলে দেখা গিয়েছে। এখনও পুরুষদের ক্ষেত্রে এই সুযোগ মহিলাদের তুলনায় বেশি। এটিও লিঙ্গগত ফারাকের কারণ হতে পারে', মনে করেন চিকিৎসক-অধ্যাপক রায়।
ঝুঁকির বিষয়...
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট বলছে, সময়ের সঙ্গে আক্রান্তের হাল খারাপ হতে থাকে। তবে যত দ্রুত রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা শুরু করা যায়, ততই রোগীকে বেশি স্বস্তি দেওয়া সম্ভব। এই নিয়ে কয়েকটি রিস্ক ফ্যাক্টরের কথাও জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
--বয়স (সাধারণত ৬৫ বছর বা তার বেশি)
--উচ্চ রক্তচাপ
--ডায়াবিটিস
--স্থূলত্ব
---ধূমপান
---অতিরিক্ত মদ্যপান
---শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা
--সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন থাকা
---অবসাদ
কী করণীয়?
কোনও একটি দিকে নজর নয়, বরং সার্বিক সচেতনতা বাড়ানোর দিকেই জোর দিচ্ছেন বেশিরভাগ ডাক্তাররা। তার মধ্যে যেমন, নিয়মিত শরীরচর্চা, সুষম আহার (সবুজ শাকসব্জি থাকা জরুরি), কার্ডিওভাস্কুলার স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তেমনই তাঁদের পরামর্শ অ্যালঝাইমার্স নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো। বয়স স্মৃতিশক্তিতে কম-বেশি প্রভাব ফেলে একথা যেমন ঠিক, তেমন এটিও মনে রাখা দরকার যে অ্যালঝাইমার্সের মতো রোগের প্রাথমিক উপসর্গ বিস্মরণ। তাই এই ধরনের ঘটনা বার বার হতে থাকলে ফেলে রাখা যাবে না। দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ও রোগনির্ণয় জরুরি। কারণ অ্যালঝাইমার্সের ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসাই কিছুটা হলেও রেহাই দিতে পারে। কমাতে পারে স্নায়ুকোষের ক্ষতির হারও। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সুজিত সরখেলের মতে, 'প্রথমেই হয়তো বড় কিছু ভুল হয় না। হয়তো ছোটখাটো কাজ, চেষ্টা করেও মনে রাখতে পারছেন না বা ঠিক করে করতে পারছেন না, এভাবে জিনিসটা শুরু হতে পারে। মূলত পরিকল্পনা বা প্ল্যানিংয়ের ক্ষমতা ধাক্কা খেতে থাকে এই পর্যায়ে। তবে সাধারণত যেটা হয়, মানুষ নিজের এই ধরনের বিচ্যুতি মানতে চান না। লুকিয়ে ফেলতে চান। তাতে কিন্তু লাভের থেকে ক্ষতি বেশি। তাই সেটা খেয়াল রাখা দরকার।'
বাস্তবিক। স্মৃতি যখন অন্যতম জীবনের অন্যতম সঞ্চয়, তখন তা এমন রোগের ছোবলে সহজে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় কি? অন্তত লড়াইটা দরকার। শুরুটা হোক সচেতনতা দিয়ে।
আরও পড়ুন:সদ্য মা হয়েছেন? ব্রেস্টমিল্কের জন্য পাতে থাকুক ৫ সুপারফুড