হু হু করে বাড়ছে রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা । রবিবারের হিসেব অনুযায়ী ২৪ ঘন্টার মধ্যে এই রাজ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার মানুষ । সারা দেশজুড়ে অক্সিজেনের আকাল । বেড না পেয়ে বাড়িতেই প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে প্রায় রোজই। বিভিন্ন পরিবার থেকে মৃত্যুর পর দেহ নিয়ে যেতেও
প্রশাসনের তরফে অনেক দেরি হচ্ছে, বলে অভিযোগ আসছে । বিভিন্ন দিক থেকে এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কার্যত দ্বিতীয় ঢেউয়ের সামনে অসহায় বোধ করছে মানুষ ।
কেন ECMO ট্রিটমেন্ট ?
প্রথম ঢেউয়ের থেকেও ভয়ঙ্করভাবে আছড়ে পড়েছে করোনার এই দ্বিতীয় ধাক্কা। উপমহাদেশে হু হু করে বাড়ছে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা। এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালে জায়গা পাওয়া হয়ে পড়েছে দুরূহ। এর উপর প্রকট হচ্ছে শ্বাসকষ্টের সমস্যা। জটিলতা দেখা দিলে রোগীকে ভেন্টিলেটরে দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ছে কিন্তু কোভিড যখন
ভয়ঙ্কর আকার নেয়, তখন ফুসফুসের যা অবস্থা দাঁড়ায়, তাতে অনেক সময় ভেন্টিলেশন তেমনভাবে কোন সাহায্যই করে না, জানালেন বিশিষ্ট চিকিত্সক কুণাল সরকার। তিনি জানালেন, ' করোনা আক্রান্তের ফুসফুস কোনও কোনও ক্ষেত্রে এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে, ফুসফুসকে বিশ্রাম দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তখন ভেন্টিলশন নয়, হাতে থাকে একটিই অস্ত্র, ECMO ট্রিটমেন্ট ।
কখন প্রয়োজন ECMO ট্রিটমেন্ট ?
২০২০ সালে করোনা যখন ভারতে প্রবল ভাবে আঘাত আনে সেই সময়ে কার্ডিয়াক ইনটেনসিভিস্ট, পালমোনোলজিস্ট এবং কার্ডিয়াক সার্জেনরা একসঙ্গে চিন্তা ভাবনা করেন এই ECMO সাপোর্টে সঙ্কটজনক রোগীদের রাখার কথা চিন্তা ভাবনা করেন । ফুসফুস যখন কাজ করা প্রায় বন্ধ করে দেয়, সেই সময়ে একটা মানুষকে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে ECMO র বিকল্প নেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ECMO সাপোর্ট ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি মিরাকল ঘটিয়েছে।
ECMO সাপোর্ট কী, তা বিস্তারে জানালেন মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের কর্ণধার চিকিৎসক কুণাল সরকার। করোনাভাইরাস সরাসরি আঘাত হানে মানুষের শ্বাসনালী তে । ভাইরাসের প্রকোপ যখন একটু বেশি হয়, তখনই তা ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে ফুসফুসের।
কী এই ECMO ট্রিটমেন্ট ?
ফুসফুস আমাদের শরীরে এমন একটি অঙ্গ, যা শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ সুনিশ্চিত করে । এটি আসলে একটি স্পঞ্জের মত যন্ত্র কিন্তু করোনার আক্রমণের পর পাথরের মত শক্ত হয়ে যায় অর্থাৎ ভাইরাস ফুসফুসের প্যাসেজগুলি একে একে ব্লক করে দেয় । যে টিস্যুগুলি মারফত অক্সিজেন আদান-প্রদান হয়ে থাকে, সেগুলিও কঠিন হয়ে যায়।
শরীরে তখন আর অক্সিজেন সরবরাহ হয় না । সেখান থেকেই শুরু হয় অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়ার সমস্যা। যা প্রাথমিকভাব ধরা পড়ে অক্সিমিটারে।
ভেন্টিলেটর আর ECMO র ফারাক
ফুসফুস যখন ক্লান্ত তখন রোগীকে ভেন্টিলেটরে দিলে মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে চেষ্টা করা হয় যাতে করে ফুসফুসকে কাজ করানো যায় । ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসের মারফতই যতটা সম্ভব অক্সিজেন যাতে শরীরে পাঠানো যায়, সেই চেষ্টাই করা হয় ভেন্টিলেটর সাপোর্টে। কিন্তু ফুসফুসের টিস্যুগুলি এত শক্ত হয়ে যায় যে, ভেন্টিলেটর সাপোর্ট তেমন সুরাহা দেয় না । চিকিৎসক সরকার জানাচ্ছেন, ২০২০তেই বিশ্বব্যাপী দেখা যায়, করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে ভেন্টিলেটর প্রক্রিয়া অন্যান্য রোগের মত সফল নয় । অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে যদি ৮০ থেকে ৯0 শতাংশ রোগী ভেন্টিলেটরে সুস্থ হয়, করোনার ক্ষেত্রে সুস্থতার হার ৩0 শতাংশ । সে ক্ষেত্রে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে এই নিয়ে
আলোচনায় বসেন চিকিৎসকরা । হার্টের কোন বড় অস্ত্রোপচারের সময় হার্ট-লাংস বাইপাস মেশিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে । কিন্তু সেই মেশিন কয়েক ঘণ্টাই কাজ করে কিন্তু করোনায় আক্রান্ত ফুসফুসকে কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম দেওয়াই যথেষ্ট নয় । সে ক্ষেত্রে একমাত্র উপায় ECMO সাপোর্ট । ফুসফুসকে যে সময় বিশ্রাম পাবে আর কাজ করবে সেই মেশিন অর্থাৎ শরীরের বাইরে থেকেই একটি যন্ত্র ফুসফুস হিসেবে কাজ করবে আর সেই সময়টা বিশ্রামে, ওষুধে, চিকিৎসায় সেরে উঠবে করোনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া ফুসফুস।
ECMO র ব্যয়
এখন প্রশ্ন, এই সাপোর্ট কতজন মানুষ পেতে পারে । পশ্চিমবঙ্গে এখন যা পরিকাঠামো, সরকারি হাসপাতালে বেশ কয়েকটি ECMO মেশিন পড়ে থাকলেও তা ব্যবহার হচ্ছে না । পরিকাঠামোগত কারণেই কলকাতার মেডিকা সুপারস্পেস্যালিটি সহ বেশ কয়েকটি হাসপাতলে ECMO সাপোর্টে ক্রিটিক্যাল করোনা রোগীদের চিকিৎসা চলছে।
পদ্ধতিগত কারণেই এই চিকিৎসা নিঃসন্দেহে ব্যয়বহুল। কারণ মেশিনের দাম তার পারিপার্শ্বিক জোগাড় যন্ত্র এবং তার রোজকার রক্ষণাবেক্ষণে বড় টাকা ব্যয় হয়ে যায় তবুও যারা সেই ব্যয় ভার বহন করতে সক্ষম তারাও সবসময় এই চিকিত্সা পাচ্ছেন না কারণ এখনও পর্যন্ত খুব সীমিত সংখ্যক ECMO মেশিন এক-একটি হাসপাতালে রয়েছে। চিকিৎসক কুণাল সরকার জানালেন, তাঁর হাসপাতালে ২০ জনের ECMO টিম, ডা. দীপাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ও ডা. অর্পণ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে চলছে। সঙ্গে রয়েছেন বিভিন্ন প্যারামেডিকেল স্টাফরা । সংখ্যায় অপ্রতুল হলেও এই ECMO সাপোর্টে ২৪ ঘন্টা বাঁচার আশা নেই, এমন রোগীরাও ভাল হয়ে বাড়ি ফিরছেন। সঙ্কটজনক অবস্থায় এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে আনা হয়েছে কোভিড আক্রান্ত বেশ কয়েকজন চিকিৎসককেও। কেউ কেউ তাঁদের মধ্যে সেরে ওঠে এই বছর করোনা
রোগীদের চিকিত্সা করছেন।
জীবন যখন প্রশ্ন চিহ্নের মুখ, তখন প্রায় নতুন জীবন দিচ্ছে ECMO । তবে এই পদ্ধতি আরও প্রসার লাভ করবে, আশা চিকিত্সকদের।