অনিমা সামন্ত, খুব ছোট বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে এখন তাঁর মেয়ের বয়স ২১। পড়াশোনার কারণে সে সুদূর বিদেশে। স্বামীও ব্যস্ত। চল্লিশের কোটায় দাঁড়িয়ে একাকীত্ব দূর করতে তাই আবারও মা হতে চান অনিমাদেবী।
এই তালিকায় রয়েছে মধ্যচল্লিশের পুনম কানহোরিয়ার গল্পও। ডিভোর্সের পর নতুন করে বৈবাহিক জীবন শুরু করেছেন পছন্দের মানুষের সঙ্গে। প্রথম পক্ষের একটি ছেলে থাকলেও নতুন জীবনে নিজের আরও একটি সন্তান চান তিনি।
সাধারণত যে বয়সে মা হন মহিলারা এরা প্রত্যেকেই সেই বয়স পেরিয়ে গিয়েছেন। তাহলে? মাতৃত্বের ডেডলাইন কোনটা? ৪০ পেরোলেই কি সন্তানধারণের ইচ্ছেতে ইতি টানাই দস্তুর? যাঁরা বেশি বয়সে মা হতে চাইছেন, যাবতীয় শঙ্কা-প্রশ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইন্দ্রাণী দাস এবং ডাঃ সুজাতা ভট্টাচার্য। বেশি বয়সী মায়েদের মানসিক অবস্থার সমস্ত খুঁটিনাটির খোঁজ জানালেন মনোবিদ সৃষ্টি সাহা।
বেশি বয়সে বাধা ঠিক কোথায়?
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুজাতা ভট্টাচার্য বলছেন, 'বয়স বাড়লে সন্তানধারণ ক্ষমতা স্বাভাবিক নিয়মেই কমতে থাকে। সন্তানকে মায়ের শরীরে বাড়তে দেওয়ার মতো পরিবেশও সব সময়ে থাকে না। বয়স বাড়লে অর্থাৎ ৪০ পেরোলে মেয়েদের শরীরে ডিম্বানুর সংখ্যা ও গুণগতমান কমতে থাকে। যা প্রেগন্যান্সিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।'
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইন্দ্রাণী দাস বলছেন, 'মাতৃত্বের ক্ষেত্রে বেশি বয়স বলতে সাধারণত ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের কথাই বলা হয়। এদের Elderly Primi Age Group-এর আওতায় ফেলা হয়।' এঁদের ক্ষেত্রে প্রেগন্যান্সি আসার ক্ষেত্রে, প্রেগন্যান্সিকালীন ও ডেলিভারির সময় একাধিক সমস্যা হতে পারে। এমনকী ডেলিভারির পরবর্তী পর্যায়েও বেশি বয়সী মায়েদের একাধিক শারীরিক সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা থাকে।
বেশি বয়সে হবু মায়ের ঝুঁকি কী কী?
ডাঃ ইন্দ্রাণী দাসের কথায়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক নিয়মেই স্বাস্থ্যের অবনতিও হয়। ফলে প্রেগন্যান্সিও জটিল হয়। ৩৫-এর পর প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা কমতে থাকে। প্রেগন্যান্সি এলেও হরমোনজনিত সমস্যায় মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ে। এ ছাড়াও ডায়াবেটিস, উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ, ওজনের সমস্যা, হাইপারটেনশন, হাই ব্লাডপ্রেসার, ইউট্রাসে টিউমারের সম্ভাবনা, স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি-সহ একাধিক রিস্ক ফ্যাক্টর তৈরি হয়।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুজাতা ভট্টাচার্যের কথায়, 'এ ক্ষেত্রে প্রেগন্যান্সি পিরিয়ড শুরুর প্রথম পর্যায়ে ( সাধারণত ১২ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে) চিকিৎসকরা কিছু মার্কার স্টাডি (Double Marker & Quadruple Marker study) করে থাকেন। এই পর্যায়ে হবু মায়ের শারীরিক অবস্থার পরিমাপ করে ক্রোমোজমের অস্বাভাবিকতা যেমন Trisomy ২১ ইত্যাদি বোঝা যায়।
এ ছাড়াও প্রেগন্যান্সি শুরুর আগে বিভিন্নরকম ব্লাড-হরমোন টেস্ট, মায়ের শরীরে কোনও রকম অস্বাভাবিকতা রয়েছে কি না ইত্যাদির পাশাপাশি ব্লাডপ্রেসার, সুগার পরীক্ষা করা হয়'। এই দীর্ঘ স্ক্রিনিং-এর মাধ্যমেই চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন সংশ্লিষ্ট মহিলা আদৌ সন্তানের ধারণের জন্য শারীরিকভাবে তৈরি কি না।
ইদানিং বেশি বয়সে মা হওয়ার ঘটনা বাড়ার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাসিসটেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনোলজির (Assisted Reproductive Technology) সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে। অভ্যুলেশন যদি ঠিকমতো না হয় সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে কিছু হরমোন, ওষুধ প্রয়োগ করে এবং চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে প্রেগন্যান্সির দিকে এগোনো হয়।
সাধারণত ৩৫-এর আগেই মা হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই পরবর্তী পরিকল্পনা করুন। হবু মায়ের হার্ট, লাং, কিডনির কার্যক্ষমতা-সহ অন্য শারীরিক অবস্থা খতিয়ে দেখে তবেই সবুজ সংকেত দেন চিকিৎসকরা।
যাঁরা বেশি বয়সে মা হওয়ার কথা ভাবছেন তাঁদের কী করণীয়
- জীবনযাপনে বদল প্রয়োজন।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন।
- হালকা ব্যায়াম করুন।
- চিন্তামুক্ত থাকুন।
- ব্লাড প্রেসার, সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত পরীক্ষা করান।
- ডায়েট ঠিক রাখুন।
- ফলিক অ্যাসিড খান।
- ধূমপান এবং মদ্যপান নৈব নৈব চ।
চিকিৎসকদের কথায় বেশি বয়সের মায়েদের ডেলিভারির পরেও বেশ কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। মেটার্নাল স্ট্রেস ফ্যাক্টরের কারণে অনেক মায়েরাই বাচ্চাকে ঠিকমতো স্তন্যপান করাতে পারেন না। পোস্টপার্টম পিরিয়ডের সময়েও মিল্ক প্রোডাকশন কম হতে পারে কিছু ক্ষেত্রে। হতে পারে একাধিক শারীরিক সমস্যাও।
Elderly Primi Age Group-এর ক্ষেত্রে Assisted Reproductive Technology বা IVF পদ্ধতি প্রয়োগের পর টুইন প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে মায়েদের বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। এ প্রসঙ্গে চিকিৎসক সুজাতা ভট্টাচার্যের পরামর্শ, 'হবু মায়ের বিশ্রাম নিন। ইনস্টিটিউশানল ডেলিভারি এদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত।'
বেশি বয়সী মায়েদের সদ্যোজাতদের সমস্যার আশঙ্কা
- বাচ্চার ওজন কম হতে পারে।
- ডিম্বাণুর গুণমান হ্রাস পাওয়ার কারণে বাচ্চা বিকলাঙ্গ হতে পারে।
- সন্তানের ডাউন সিনড্রোম হওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
- বাচ্চার বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে।
তবে সময় বদলেছে, মহিলারা অনেকেই চান ব্যক্তিজীবনে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে তবেই মাতৃত্বের পরিসরে প্রবেশ করতে। সে ক্ষেত্রে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক কিছু দিকেও নজর রাখা জরুরি। মনোবিদ সৃষ্টি সাহা জানাচ্ছেন, 'বেশি বয়সে মাতৃত্বের যেমন অসংখ্য খারাপ দিক রয়েছে, তেমন কিছু ভালদিকও রয়েছে।'
ভাল দিক কী কী
- এ ক্ষেত্রে বেশি বয়সের মায়েরা অনেক বেশি ম্যাচিওরড হন।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেও আর্থিকভাবেও তাঁরা বেশি সক্ষম।
- এ ছাড়াও দাম্পত্যের অবস্থানও অনেক বেশি পোক্ত হয়।
- বেশি বয়সের কারণে মানসিকভাবে অনেক বেশি স্থির হয়ে থাকেন বেশি বয়সী মায়েরা।
- পাশাপাশি অভিজ্ঞতাও বেশি। ফলে সবদিক মিলিয়ে একটা বৃহৎ পরিসর সামলে নিয়ে মা হওয়ার ফলে সন্তানের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া সহজ হয়। অনেক ভালভাবে বেড়ে ওঠে বেশি বয়সী মায়ের সন্তানরা।
তবে এ ক্ষেত্রে খারাপ দিক রয়েছেই, মধ্যত্রিশে যে সন্তান জন্ম নিচ্ছে, বড় হতে হতে মায়ের বয়স অনেকটাই বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে কিছু সামাজিক খোরাকের পাত্র হতে পারে সন্তান। যার প্রভাব পড়ে মায়েদের ক্ষেত্রেও। এ ছাড়াও পারিপার্শ্বিক চাপ তো রয়েছেই। 'সন্তান ঠিকমতো মানুষ হচ্ছে তো'-র মতো চিন্তা, পোস্টপারটমে Postnatal depression, অত্যধিক মানসিক চাপ ইত্যাদি তো থাকেই।
তবে চিকিৎসাবিজ্ঞান আজ সাবালক। কোনও কিছুই আর অসম্ভব নয়। তাই শুধু অনিমাদেবী বা পুনম কানহোরিয়া নন। এমন অনেকেই রয়েছেন যাঁরা বিভিন্ন কারণে ৪০-এর পরে মা হতে চান। নজির গড়ে পঞ্চাশের থেকে ষাটের পরেও মা হওয়ার উদাহরণ রয়েছে আমাদের চারপাশে। কেরিয়ার, সংসার সমান্তরালভাবে সামাল দিয়ে মধ্যচল্লিশের কোটায় গিয়েও মা হওয়া তাই অস্বাভাবিক নয়। তবে প্রাকৃতিক নিয়মে কিছু সমস্যা তো থাকেই। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতির দিকটা একটু নজর দিলেই মাতৃত্বের স্বাদ তাই অধরা নয় বেশি বয়সেও।