পায়েল মজুমদার, কলকাতা: 'প্রায়ই শুনি মাথাব্য়থা! অফিস থেকে ফিরে আলো নিভিয়ে শুয়ে থাকে। কখনও আবার বমিও করে। ভাল করে ডাক্তার দেখায় না কেন কে জানে।'কথাগুলো চেনা চেনা লাগছে তো? সমস্যাটা যেমন কাল্পনিক নয়, তেমন অবাস্তব নয় এই ধরনের পরামর্শও। সমস্যার নাম? মাইগ্রেন (Migraine Pain)। শব্দটা চেনা। এই সমস্যায় ভোগেন, আশপাশে এমন মানুষের সংখ্য়াও নেহাত কম নয়। কিন্তু সমস্যাটি যে পুরুষদের (Migraine Pain In Men) তুলনায় নির্দিষ্ট বয়সের মহিলাদের (Migraine In Women) অনেক বেশি ভোগায়, সে কথা হয়তো অনেকের অজানা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাই বন্ধুবান্ধব থেকে পরিবারের সদস্য সকলেই মনে করেন, 'ভাল করে ডাক্তার দেখায় না কেন কে জানে।'মাইগ্রেন-চিকিৎসায় ডাক্তারি পরামর্শ জরুরি, ক্ষেত্রবিশেষে ওষুধও দরকার। কিন্তু যেটা ভুললে চলবে না, তা হল, মহিলারা সার্বিকভাবে শারীরবৃত্তীয় (Hormonal Reason) কারণে পুরুষদের তুলনায় তিন-চার গুণ বেশি মাইগ্রেনের সমস্যায় ভোগেন।
মাইগ্রেন কী?
মাথার যে কোনও একদিকে কি প্রায়ই দপদপে যন্ত্রণা হয়? সঙ্গে গা-বমি ভাব, বমি ইত্যাদিও হতে থাকে? জোরাল আলো বা জোরে আওয়াজে কষ্ট হয়? তা হলে একটু সতর্ক হওয়া দরকার। কারণ, এগুলি মাইগ্রেন-এর উপসর্গ। কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত এই ব্যথা থাকতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে মাসে এক-দু'বার এই ধরনের কষ্টকর অভিজ্ঞতা হয়। আবার কারও ক্ষেত্রে মাসে ঘন ঘন এই জিনিস হতে পারে। অর্থাৎ ব্যক্তিভেদে মাইগ্রেনের প্রকৃতি, স্থায়িত্ব, ব্যথার ধরন এবং তীব্রতা আলাদা। শুধু তাই নয়। একই মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বয়সে মাইগ্রেনের সমস্যা এক এক রকম হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, মহিলাদের ক্ষেত্রে বয়সের সঙ্গে মাইগ্রেনের ফারাক অনেক বেশি ধরা পড়ে। সোজা করে বললে, এটি এক ধরনের জটিল স্নায়বিক সমস্যা যার পিছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে।
লিঙ্গগত ফারাক...
পুরুষদের মাইগ্রেন হয় না, এমন নয়। কিন্তু একাধিক গবেষণায় স্পষ্ট, মহিলাদের মধ্যে মাইগ্রেনের সমস্যা পুরুষদের তুলনায় ৩-৪ গুণ বেশি। তবে, মহিলাদের মধ্যে এক এক বয়সে
মাইগ্রেনের প্রকৃতি, স্থায়িত্ব, ব্যথার ধরন এবং তীব্রতার এক এক রকম হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর মূল কারণ হরমোনের ওঠানামা।
মহিলাদের মধ্যে মাইগ্রেন কেন বেশি?
১)ঋতুস্রাব বা মেনস্ট্রুয়েশন
২) ওরাল কনট্রাসেপটিভ
৩) প্রেগন্যান্সি
৪) ল্য়াকটেশন
৫) মেনোপজ বা ঋতুবন্ধ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহিলাদের মধ্যে যে হরমোনের কারণে মাইগ্রেনের সমস্য়া বাড়তে পারে, তার নাম ইস্ট্রোজেন। মেয়েদের প্রজনন তন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে ইস্ট্রোজেনের। মাসিক বা ঋতুস্রাবের নেপথ্যেও মূল কারিকুরি থাকে এই হরমোনেরই। তাৎপর্যপূর্ণভাবে ডাক্তাররা মনে করেন, ইস্ট্রোজেনের মাত্রার তারতম্য মহিলাদের মাইগ্রেন-সমস্যার বড় কারণ। RSV হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ জয়তী মণ্ডলের কথায়, ' সাধারণত ইস্ট্রোজেন যখন চরম মাত্রায় থাকে, তখন এই ব্যথা বেশি হতে চায়। কারণ ইস্ট্রোজেন ব্লাড ভেসেলের প্রসারণ ঘটায় যা থেকে স্প্যাজম হতে পারে, বাড়তে পারে মাইগ্রেনের ব্যথা।' ডক্টর মণ্ডলের মতে, 'খেয়াল করলে দেখা যাবে, বহু মহিলারই ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার ২-৩ দিন আগে মাইগ্রেন সমস্যা বেশি হতে চায়। কারও কারও আবার ঋতুস্রাব চলাকালীনও যন্ত্রণা হতে পারে।'
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, এই সমস্যা মূলত ঋতুযোগ্য বয়সের মেয়ে ও মহিলাদেরই (২০-৫০ বছর) বেশি ভোগায়। তাই বহু ডাক্তারের অভিজ্ঞতা বলছে, একটা বয়সের পর বড় অংশের মহিলাদের মাইগ্রেন নিজে থেকেই সেরে যেতে পারে। বিশেষত মেনোপজ বা ঋতুবন্ধের পর এই সমস্যা কমে যেতে দেখা যায়। R N Tagore Hospital-এর স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ অনিমেষ কর যেমন মনে করেন, '৬০-৭০ শতাংশ মহিলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, ৫০ বছরের পর মাইগ্রেনের যন্ত্রণা থাকে না। খুব অল্প কিছু ঘটনায় ব্যথা থাকে বা বেড়ে যায়।' কিছুটা একই ঘটনা ঘটতে পারে প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রেও। ডক্টর করের মতে, 'মাইগ্রেনের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় এমন বহু মহিলার ওষুধ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে সন্তান নিতে চান না। কিন্তু সাধারণত দেখা যায়, প্রেগন্যান্সি যত এগোয় তত যন্ত্রণা কমে আসে। এও কিন্তু হরমোনেরই কারসাজি।'
কী করণীয়?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, নিজের থেকেই কমে গেলে, এই অসুবিধার আর চিকিৎসার আর দরকার কি? স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ জয়তী মণ্ডলের মনে করেন, চিকিৎসা না করে ফেলে রাখলে মাইগ্রেন বড়সড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাঁর কথায়, 'দেখা গিয়েছে 'গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মাইগ্রেনে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে স্ট্রোকের আশঙ্কা ১৬-১৭ বেশি। তা ছাড়া, সন্তানপ্রসবের সময়ও জটিলতা তৈরি হতে পারে।' কাজেই এটি ফেলে রাখা যাবে না।
যা যা করতে হবে...
স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ অনিমেষ করের মতে, 'টেনশন থেকে মাথাব্যথা হতে পারে, অন্য কারণও থাকতে পারে। এটি যে মাইগ্রেনের কারণেই হচ্ছে, সেটা আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার। তার জন্য রোগনির্ণয় জরুরি।' এর পরে আসে চিকিৎসার পর্যায়। স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ অনিমেষ করের কথায়, 'যদি আপনার মাসে-দু'মাসে এক বার মাইগ্রেনের যন্ত্রণা হয়, তা হলে মোটেও টানা ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু এক মাসে ৩-৪ বারের বেশি সমস্যা হলে ভেবে দেখা দরকার কারণ সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পারিবারিক জীবন থেকে পেশাদার দায়িত্ব, বিভিন্ন দিকে ধাক্কা লাগতে পারে।' তবে শুধু ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করলেই যে মাইগ্রেন সেরে যাবে, এমন ভাবনা পুরোপুরি ঠিক নয়। ওষুধ তো বটেই, পাশাপাশি জীবনশৈলি বদলানো দরকার।
জীবনশৈলিতে বদল...
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ জয়তী মণ্ডল জানালেন, মাইগ্রেন নিয়ন্ত্রণে আনতে
- ক্যাফিন জাতীয় পানীয় সেবন একেবারে কমিয়ে ফেলতে হবে
- বন্ধ করতে হবে ধূমপান
- চকোলেট খাওয়ায় রাশ টানতে হবে
- অতিরিক্ত কোলেস্টেরল রয়েছে, এমন খাবার খাওয়া যাবে না
- যতটা সম্ভব স্ট্রেস কমাতে হবে
অল্প কথায়, চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে যেমন প্রয়োজনমতো ওষুধ খাওয়া জরুরি, তেমনই বদলানো দরকার জীবনশৈলিও। কিন্তু তার পরও সমস্যা পুরোপুরি চলে যাবে এমন নয়। বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা হতে পারে। তা সত্ত্বে প্রয়োজনমতো ওষুধ খাওয়া ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় ক্ষান্তি দিলে চলবে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমস্যা নিজেই অনেকটা কমে আসবে। আর বাকিটা হয়তো সময় মেনে হবে।
আজকের নারীদের পারিবারিক ও পেশাদার জীবন দুই-ই দুহাতে সামলাতে হয়। সে সব করতে গিয়ে মাইগ্রেনকে ফেলে রাখা চলবে না।
আরও পড়ুন:হাড়ের গঠন হবে শক্ত-মজবুত, দৈনন্দিন জীবনে মেনে চলুন এই সহজ নিয়মগুলি