কলকাতা : ২০২১। কুড়ির আতঙ্ক কাটানো গেল না । করোনা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিল এই বছর। 2021 এর এপ্রিল-মে মাসে দ্বিতীয় ঢেউ দেখল ভারত, যা দেখালো মৃত্যু-মিছিল, সারি সারি জ্বলতে থাকা চিতা, গণকবর, অক্সিজেনের হাহাকার...অতিমারীর কাছে অসহায় হয়ে পড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা ।
বছরের শুরুতে ভ্যাকসিন চালু হলেও, নানা কারণে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ কড়া হাতে মোকাবিলা করতে পারেনি ভারত । সেই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন হল আরও কিছু রোগের প্রাদুর্ভাবে ।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ( Black Fungus )
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সঙ্গেই ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস। এমন নয় এর আগে কোনওদিন এই রোগ কারও হয়নি। তবে করোনায় কমে যাওয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা এই ফাংগাসের আক্রমণকে আরও সহজ করল । নানারকম উপসর্গ নিয়ে এই রোগ দেখা দিল। ফাংগাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে থাকল মস্তিষ্কেও। রোগীকে হারাতে হলো দৃষ্টি । অস্ত্রোপচার করতে হল ব্রেনেও। চিকিৎসকদের একাংশের মতে করোনাকালে অতিরিক্ত স্টেরয়েড ব্যবহারের কারণে করোনা পরবর্তীতে এই অসুখ বেশি করে দেখা দিল। চোখে কম দেখা, ডাবল ভিশন, মুখের এক দিকে যন্ত্রনা, অসাড় হয়ে যাওয়া, নাক-কান দিয়ে কালো তরল বের হওয়া, এই রোগের অন্যতম লক্ষণ। এই রোগে মারা গেলেন বেশ কিছুজন।
অ্যাভ্যাসকুলার নেক্রসিস বা Avascular necrosis
করোনা পরবর্তীতে আরও কয়েকটি রোগের দাপট দেখা যায়। তার মধ্যে অন্যতম হল অ্যাভাসকুলার নেক্রসিস । কোভিড পরবর্তীতে এই রোগ অনেকের মধ্যে দেখা দেয়। চিকিৎসকদের একাংশের মতে স্টেরয়েডের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এই রোগ হতে পারে। এই রোগকে অস্টিও নেক্রসিসও বলা হয় । রক্তের সরবরাহ সঠিকভাবে না হওয়ায় হাড়ের টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। তার ফলে এই রোগ হয়ে থাকে। এই রোগের ফলে হাড় ভঙ্গুর হয়ে ভেঙ্গে যায় । স্বল্প আঘাতেই হাড় ভেঙে যাওয়া এই রোগের অন্যতম লক্ষণ !
মায়োকার্ডিটিস ( Myocarditis ), ভাসকুলাইটিস (Vasculaitis)
কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে যেমন প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে, হার্টের মাসলেও তেমন প্রদাহ হয়। যাকে বলে myocarditis (Myocarditis is an inflammation of the heart muscle myocardium)। করোনা আক্রান্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই হৃদপিণ্ডের মাসল মায়োকার্ডিয়ামে ইনফ্লামেশন দেখা দিল অনেকেরই । করোনা পরবর্তীতে হার্টের রোগীর সংখ্যা গেল বেশ বেড়ে। এছাড়াও কোভিডের পর, হৃদপিণ্ডের আরও একটি সমস্যা দেখা দিল বহুলভাবে। যাকে চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় বলে ভাসকুলাইটিস বা vasculitis। হৃদপিণ্ডের রক্তজালিকায় রক্ততঞ্চন ঘটে অর্থাৎ হার্টের ধমনীতে রক্ত জমাট বেঁধে সমস্যা তৈরি করল। করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেরই কোভিড থেকে সেরে ওঠার পর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। সেক্ষেত্রে অ্যাঞ্জিওগ্রাম করে দেখা গেছে, করোনারি আর্টারিতে (coronary artery disease) রক্ত জমাট বেঁধেছে। সেই ক্লট রিমুভ করতে হয়েছে।
ডেঙ্গি বা Dengue
পিছু ছাড়ল না মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গি । ভারতের বেশ কিছু জায়গায় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু । রক্তে প্লেটলেট কমে যাওয়া, জ্বর বেড়ে যাওয়া শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া সারা শরীরে অসংখ্য গুটি গুটি দাগ, বারবার বমি হওয়া অসহ্য মাথা যন্ত্রণা এবং শরীরের ভিতরে বা বাইরে রক্তপাতের মতো ঘটনা ডেঙ্গুর লক্ষণ । এছাড়াও ডায়রিয়া, রক্ত জমাট বাঁধা, টানা জ্বর, পেটের যন্ত্রণার মতো লক্ষণ নিয়েও আসেন ডেঙ্গি রোগীরা। ডেঙ্গি বাড়াবাড়ি হলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই বছরে তার ব্যতিক্রম হয়নি। শীতেও জারি আছে ডেঙ্গু আতঙ্ক।
জিকা ভাইরাস ( Zica Virus )
২০২১ এ আমাদের দেশ দেখেছে জিকা ভাইরাসের আক্রমণও। শিশুদের মূলত ঘায়েল করেছে এই রোগ। জিকা ভাইরাসে বাচ্চাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে ভেঙে যায় । সেই সঙ্গে আক্রান্ত হয় তাদের স্নায়ুতন্ত্র। উত্তরপ্রদেশের কানপুরে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায় এই বছর। আক্রান্ত হন সন্তানসম্ভবা মাও । তবে এই রোগ একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সারা ভারত কেঘায়েল করতে পারেনি।
নিপা ভাইরাস বা Nipah Virus
এবছরও চোখরাঙানির ছিল নিপা ভাইরাসের । নিপা ভাইরাস ভয়ঙ্কর সংক্রামক, নিঃসন্দেহে মারণ রোগ। এবছর কেরলে নিপা আক্রান্ত হয়ে এক কিশোরের মৃত্যু হয় মস্তিষ্কে প্রদাহ নিয়ে ভর্তি হয়েছিল ছেলেটি । এরপর রক্ত পরীক্ষা করে ধরা পড়ে, তার শরীরে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয় সেই রাজ্য প্রশাসন। তার সংস্পর্শে আসা শতাধিক মানুষকে সনাক্ত করে তাদের রক্ত পরীক্ষা করা হয় এবং কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়।
মাল্টি সিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোম ইন চিলড্রেন (Multi SystemInflammatory Syndrome - MIS-C)
একেবারে সদ্যোজাত থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার দোরগোড়ায় পৌঁছানো ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই এই রোগ দানা বাঁধতে দেখা গিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবন কেড়ে নিয়েছে এই অসুখ। কোভিড থেকে সেরে ওঠার পরেই এই রোগ হতে দেখা গিয়েছে অনেক শিশুর। চিকিত্সা করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা আক্রান্ত হয়েছে একথা জানতেই পারেননি অভিভাবকরা। কারণ তাদের কোনও রকম উপসর্গই হয়নি। হয়ত পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেখান থেকে হয়ত সংক্রমিত হয়েছিল শিশুটিও। কিন্তু পরিবারের মানুষ জানতেই পারেননি। পরে দেখা গিয়েছে জ্বর-জ্বালা সহ আরও কিছু উপসর্গ। কোনওভাবেই জ্বর না ছাড়ায় যখন বাবা-মা বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে আসছেন, তখন দেখা গিয়েছে শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি রয়েছে। অর্থাত্ সে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিল। খুব বেশি বাড়াবাড়ি হলে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
যক্ষ্মা বা TB
সর্দি কাশি, ঘুষঘুষে জ্বর। ওষুধ খেয়ে সর্দি কমা, আবার ফিরে আসা। বিশেষত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। করোনাকালে এমন উপসর্গ নিয়ে আসা শিশুদের যক্ষ্মা ধরা পড়ে। করোনা আতঙ্কের মধ্যেই ভয় ধরিয়েছে যক্ষ্মা রোগের বিষয়টি। কারণ করোনা অতিমারীর আগে থেকেই ভারতে যক্ষ্মা রোগের চিত্রটা বেশ ভয়াবহ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা কিছুটা কমলেও জ্বর, কাশি, পেটে ব্যথার মতো উপসর্গ নিয়ে আসছে বেশ কিছু শিশুই। দেখা গেল, তাদের কারও কারও হয়েছে যক্ষ্মা বা টিবি (Tuberculosis )। ভারতে যক্ষ্মা বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ক্রমাগত চিকিত্সা, টিকাকরণ, সচেতনতা ও সরকারি উদ্যোগে সংক্রমণে কিছুটা রাশ টানা গেলেও করোনাকালে বেশ কিছু কারণে ছড়ানোর সম্ভাবনা বেড়েছে টিবি-র। Management Information System (NHM-HMIS) - এর তথ্য অনুসারে লকডাউনের ফলে টিবি রোগের চিকিৎসায় অনেক ক্ষতি হয়েছে । চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ায় রোগের চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে, তা দ্রুত সামলে ওঠা কঠিন । সেইসঙ্গে করোনাকালে কমে যায় টিবির টিকাকরণও।