পল্লবী দে, কলকাতা: কালী (Kali) নাম শুনতেই চোখে ভেসে ওঠে এক দিগম্বরী রূপ। যিনি কাজলের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা, মুক্তকেশী, বিবস্ত্রা, চতুর্ভুজে তাঁর বীরত্বের ব্যঞ্জনা। মন্ত্রচ্চারণে যাকে আমরা বলে থাকি, "করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম্। কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাম্"। ভারতবর্ষের (India) অন্যতম প্রধান শক্তিদেবতা তিনি, দশ মহাবিদ্যার অন্যতমাও। তবে এই কালীর নামেই যেন বিভীষিকা, রূপে তো বটেই। তবে এটি কিন্তু আমাদের ভ্রম নয়। পুরাণের (Mythology) নানাবিধ কাহিনিতে তাঁর এমনই রূপের উল্লেখ রয়েছে। কালিকাপুরাণ, মার্কেণ্ডেয় পুরাণ, শ্রী শ্রী চণ্ডী থেকে মহাভারতে (Mahabharat) কালীর রূদ্র ও সংহাররূপের বর্ণনা পাওয়া যায়।
এখন প্রশ্ন ওঠে কালীর নামকরণ নিয়ে। রূপের উল্লেখ পাওয়া যায় সেই ঋগ্বেদ (Veda) থেকে৷ সেখানে তিনি পরম তেজ স্বরূপা,দেবতেজসম্ভূতা চণ্ডীর সঙ্গে কালীর তেজ এবং শক্তি অভিন্না৷ আবার মার্কেণ্ডেয় পুরাণে তিনিই করালী। মানুষের রোগ, ভয়, তাপ এবং পাপের দাহিকা হিসেবে তিনি বিরাজমান। কিন্তু তিনি কালী কেন? ব্যাকরণগত ব্যাখ্যা, ‘কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। অন্যদিকে, মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে, এই কাল শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে 'মহাকাল' অর্থে৷ অর্থাৎ সর্বপ্রাণীকে কলন (গ্রাস) করেন যিনি। তাই কালকে গ্রাস করেন বলেই তিনি কালী।
তবে শুধু নাম নয়। কালীর সংহাররূপ নিয়েও নানা ব্যাখা রয়েছে৷ শাস্ত্রবিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সেই রূপ থেকেও দেবীর নানা নামকরণ হয়েছে। যেমন মহাভারত। ব্যাসদেবের রচনায় কালীর রূপ ভয়ঙ্কর। সেখানে তিনি সংহাররূপী৷ সৌপ্তিক পর্বে যেখানে সেনাপতি হিসেবে অশ্বত্থামা যখন দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রকে বধ করেছেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডীকে বধ করেছেন, তখন সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধদুর্মদ অশ্বত্থামার পাশে যে কালীকে দেখা গিয়েছিল, তাঁর মুখখানি লাল, চোখ দুটিও লাল, গলায় লাল ফুলের মালা, পরনে লাল কাপড় এবং হাতে পাশ অস্ত্র। এই কালীকে ধ্বংসের প্রতীক কালরাত্রি বলা হয় মহাভারতে।
আরও পড়ুন, ৫৭০ ভরি সোনার গয়নায় সাজলেন বীরভূমের ‘কেষ্ট কালী’
ব্যাসদেবের কথায়, 'কালীং রক্তাস্যনয়নাং রক্তমাল্যানুলেপনাম্। রক্তাম্বরধরামেকাং পাশহস্তাং কুটুম্বিনীম্।' মহাভারতে বর্ণিত এই কালীর পৃথক সত্তা এবং পৃথক রূপটি কিন্তু বঙ্গদেশীয় কালীর সঙ্গে অনেক বেশি মেলে। শশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর 'ভারতের শক্তি সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য' বইটিতে লিখেছেন, "কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তন্ত্রসার গ্রন্থে সিদ্ধেশ্বর তন্ত্র থেকে কালীর যে ধ্যানমন্ত্র উদ্ধার করেছেন, তাতে কালীর রূপ কিন্তু দক্ষিণাকালীর রূপ। দক্ষিণা কালী করালবদনা, তাঁর আকৃতি ভয়ঙ্কর। কেশ আলুলায়িত চতুর্ভুজা। গলায় নরমুণ্ডের মালা। তাঁর বামভাগের নীচের হাতটিতে সদ্যচ্ছিন্ন মুণ্ড, ওপরের হাতে খড়্গ। এই কালীমূর্তির দক্ষিণভাগে নীচের হাতটিতে অভয় মুদ্রা আর ওপরের বরদানের মুদ্রায় কল্পিত। তাঁর গায়ের রঙ প্রগাঢ় মেঘের মতো কালো, তিনি নগ্না দিগম্বরী। দেবীর গলায় মুণ্ডমালা, কর্ণে দুটি শবশিশু ভূষণরূপে বিরাজমান, তাতে দেবীর আকৃতি আরও ভয়ানক হয়ে উঠেছে। দন্তশ্রেণী ঘোররূপা।"
তবে এও ঠিক কূর্ম পুরাণে কালীনামও নেই, কৃষ্ণার ইঙ্গিতও নেই। শরীরের বর্ণনায় দেবীর কালীরূপ ব্যঞ্জিত হয়ে ওঠে- নীলপদ্মের মতো তাঁর বর্ণ, নীল পদ্মের সুগন্ধ তাঁর শরীরে। দ্বিভুজ দ্বিনেত্র সেই মনুষ্য শরীরে তিনি নীল, তাঁর কেশরাশি কেবল কালো।
শাক্তমতে কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির আদি কারণ। যে মহাকাল সব রঙকে গ্রাস করেই কালো। সেই কালো রূপেই কালী দিগম্বরী, তিনি রূদ্ররূপের প্রতীক, তিনি সংহাররূপী। কখনও চামুণ্ডা, কখনও মহাকালী, কখনও শ্যামা। তিনি সেই শক্তির আধার, যিনি আঁধারে উপাসিত হন, তিনি বঙ্গদেশের সেই অধিষ্ঠাত্রী দেবী। পাপ, কাম, লোভ, ঘৃণা কলন করে আলোর উৎসবেও তিনি কালো, তিনি কালী।