কলকাতা :  ‘আদরিনী মাগো, আজ সকালে খুব ভোরে গীর্জায় গিয়েছিলাম সারার জন্য প্রার্থনা করতে। সেখানে সবাই মেরীর কথা ভাবছিল।  হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল তোমার কথা।'
সঙ্ঘজননী মা সারদাকে লিখছেন তাঁর আদরের খুকি। তিনি আইরিশ দুহিতা। তিনি ভিন্নধর্মজাতিকা। তবু তাঁর কাছে গেলে ছোট্ট শিশুটি হয়ে যান তীক্ষ্ম বুদ্ধসম্পন্না, অসীম সাহসের অধিকারী স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা। তিনি মার্গারেট এলিজ়াবেথ নোবেল। তিনি ভগিনী নিবেদিতা। তিনি অগ্নিকন্যা। 


১৭ মার্চ। বাগবাজার ।  ১০/২ নং বোসপাড়া লেনের বাড়ি। অন্দরে মা অধিষ্ঠিতা। প্রায় ঘোমটা আড়ালেই ঢাকা থাকত তার মুখ। কিন্তু রক্ষণশীনতার শিকলে কখনও আটকা পড়েনি মন।  শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী  সারদাদেবীর প্রথম দর্শন। তিনি তখন শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের চালিকাশক্তি। অথচ সর্বসাধারণের থেকে আড়ালেই। বহু পুস্তকে নথিবদ্ধ রয়েছে প্রথম সাক্ষাতের সেই মুহূর্তটি। সারদা দেবীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তিন বিদেশিনী। বহু উৎসাহী চোখ সেদিকে। 
সে যুগে হিন্দু বিধবা কিনা ভিন দেশীদের সান্নিধ্যে আসবে ! সবাইকে অবাক করে মা সেদিন মিষ্টি জল খেলেন তাঁদের সঙ্গেই। জানা যায় দুই ভিন ভাষার মানুষের মধ্যে প্রথম কথা বলেছিলেন নিবেদিতাই। মৌনতা ভেঙে তিনি বলে উঠেছিলেন ‘কী যে অপরূপ দেখতে'! মা-এ মৃদু হসেছিলেন। সেদিনের সেই সাক্ষাতে স্বামীজী যতটা মুগ্ধ  হয়েছিলেন, ততটাই স্বস্তি পেয়েছিলেন নিবেদিতাকে এভাবে মা গ্রহণ করেছেন দেখে। কারণ তাঁর মাধ্যমেই নারী উন্নয়নের জোয়ার আনতে চেয়েছিলেন বিবেকানন্দ।  সেদিনটাই প্রমাণ করে দিয়েছিল কেন মায়ের উপর আগামীর ভরসা রেখেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। 



সদ্য সাগর পেরিয়ে আসা,  ভারতকে স্বামী বিবেকানন্দর দৃষ্টিতে চিনতে শুরু করা, এক বিদেশিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ-জায়ার। কেউ কারও ভাষা জানেন না। অথচ নয়নে নয়নে কথোপকথন যে কত সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে দিতে পারে তার প্রমাণ এই মা-মেয়ের সম্পর্ক। পরবর্তীতে দুজনের বহু বাঙ্ময় সাক্ষাৎ ঘটেছে। কিন্তু প্রথম সাক্ষাতে সেই সময়ের গোঁড়া হিন্দু সমাজের মধ্যে থেকে তিন বিদেশিনীর সঙ্গে এমন অটুট সম্পর্ক গড়ে ওঠার নিদর্শন ইতিহাসে বিরল। 


মার্গারেটের ভাষায় সেই দিনটি ছিল ‘Day of days’। তখনও তিনি নিবেদিতা  হননি। তিনি মার্গারেট । সঙ্গে আরও দুই বিদেশিনী ছিলেন মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস সারা ওলি বুল । প্রথম সাক্ষাতে মা তাঁদের স্বাগত জানিয়েছিলেন, আমার মেয়েরা বলে। ব্রাহ্মণের বিধবা হয়েও একসঙ্গে বসে গ্রহণ করেছিলেন ফল-মিষ্টি প্রসাদ। তিনি যেন সেভাবেই বিদেশিনীদের  হিন্দু অন্তঃপুরে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বলে রাখা ভাল সেই যুগে নিবেদিতাকে তাঁর স্কুলের জন্য ছাত্রী জোগাড় করতে গিয়ে যেখানে অভিভাবকদের হাতেপায়ে পড়তে হয়েছিল, সমাজের একাংশ প্রথম-প্রথম তাঁকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল ভিনধর্মের জাতিকা বলে, সেখানে হিন্দু ব্রাহ্মণ বিধবা শ্রীমা তাঁকে কন্যার মর্যাদা দিয়েছিলেন। 


পরবর্তীতে নিবেদিতা ও নিবেদিতার স্কুলের মেয়েদের প্রতি যে তিনি অশেষ আশীর্বাদ বর্ষন করেছেন, সে কাহিনি স্বল্প পরিসরে আঁটার নয়। সে যুগে বাঙালি সমাজে স্ত্রী জাতি সম্পর্কে যে অবজ্ঞা ছিল তার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সেই ভাবনায় ব্রতী হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। আর সেই কাজটির বাস্তবে রূপ দিতে যে প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল, সেই প্রতিমূর্তিই হলেন মা সারদা।  শ্রীরামকৃষ্ণ নারীমুক্তি আন্দোলন সংগঠন করেননি। কিন্তু তার ভিত প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিলেন এই বলে যে যত স্ত্রী সবই তিনি। তিনি অর্থে ঈশ্বর। রামকৃষ্ণ মনে করতেন সন্তানধারণ করলেই শুধু মা হওয়া হয় না, মাতৃভাব এক মহান আদর্শ। আর এই আদর্শটিই আমৃত্যু সকলের সামনে তুলে ধরেছেন সারদাদেবী। 
মায়ের কাছে সিস্টার ছিলেন এক্কেবারে ছোট্ট এক বালিকা। মায়ের মুখপানে চেয়ে থাকতেন পাঁচ বছরের শিশুর মতো। মাকে আসন পেতে দিয়ে বারবার তাতে চুম্বন করতেন আহ্লাদী মেয়ের মতো। নিবেদিতা রাতে যখন মাকে দেখতে যেতেন তখন চোখে আলো লাগবে বলে আলোর উপর কাগজ লাগিয়ে দিতেন, পাছে মায়ের চোখে কষ্ট হয় । মাকে প্রণাম করার সময় নিবেদিতা একটা কাপড়ে করো আলতো করে মা মুছিয়ে মাথায় ঠেকাতেন। 


একদিকে যখন রক্ষণশীল সমাজের একাংশ তাঁর ছোঁয়া এড়াতে ব্যস্ত, তখন মা সারদা তাঁকে ঠাকুরের ভোগ রান্না করারও অধিকার দিয়েছেন। তা নিয়ে নারীমহলে ফিসফাস হলেও তা গ্রাহ্য করেননি তিনি । বরং বলেছেন, নিবেদিতা আমার মেয়ে। ঠাকুরকে ভোগ নিবেদন করার অধিকার তাঁর আছে।


শুধু নিবেদিতা নন, বিদেশের অন্যান্য মহিলা ভক্তদেরও তিনি কাছে টেনে নিয়েছিলেন গভীর ভাবে। নিবেদিতা এরিক হ্যামন্ডকে লেখা এক চিঠিতে লিখছেন,' This gave us dignity and made my future work possible in a way nothing else could possibly ever done. '


পরবর্তীতে সিস্টার মা-কে যত দেখেছেন তত মুগ্ধ হয়েছেন। এক পল্লীগ্রামের বধূ হয়েও রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের কত কঠিন সমস্যাও তিনি সামলে দিতেন। রামকৃষ্ণ অনুগামীদের মধ্যেও কোনও বিরোধ বা সংশয় হলে তিনি দূর করে দিতেন বিচক্ষণতায়। তাই তো তিনি সঙ্ঘজননী। একসময় নিবেদিতার মনে প্রশ্ন জেগেছে, সারদাদেবী কি পুরাতন আদর্শের শেষ প্রতিনিধি নাকি নতুন আদর্শের অগ্রদূত ? 


নিবেদিতা ও সারদাদেবীর সম্পর্কের কথা বলতে গেলে অবশ্যই এসে পড়বে নিবেদিতা স্কুলের প্রসঙ্গ। নারীমুক্তি আন্দোলন ঘটাতে গেলে প্রথমেই শিক্ষার আলো দেখাতে হবে। তাই স্বামীজী ও নিবেদিতার প্রথম স্বপ্ন ছিল মেয়েদের একটি স্কুল স্থাপন। যেখানে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান, বিচারবুদ্ধির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া গিয়েছিল প্রাচ্যের সংষ্কার ও ভাবাদর্শ। এই বিদ্যালয়ের প্রাণপ্রতিষ্ঠাও করেছিলেন সারদাদেবী। বলেছিলেন, আমি প্রার্থনা করছি, যেন এই বিদ্যালয়ের উপর জগন্মাতার আশীর্বাদ বর্ষিত হয় এবং এখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েরা যেন আদর্শ বালিকা হয়ে ওঠে। 'নিবেদিতাও বলেছিলেন তাঁর বিদ্যালয় ও মেয়েদের কাছে এর থেকে বড় আশীর্বাদ আর কিছুই হতে পারে না। সেই সময় স্কুলের নাম ছিল রামকৃষ্ণ গার্লস স্কুল, যা অধুনা রামকৃষ্ণ সারদা মিশন সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুল। জানা যায়, নিবেদিতার স্কুলটি মা সারদার বাড়ির কাছে হওয়ায় তিনি প্রায়ই মায়ের সাক্ষাতে যেতেন ছাত্রীদের নিয়ে। কারণ তাঁর ভাবের নদীটিই তিনি ছাত্রীদের মধ্যে বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। 



বাগবাজারে নিবেদিতা স্কুল


 


শ্রীমা যখন  কলকাতায় থাকতেন, তখন প্রতি সন্ধেয় তাঁর কাছে ছুটতেন নিবেদিতা ও ভগিনী ক্রিস্টিন। দুজনেই মায়ের সান্নিধ্য লাভ করতেন। নিবেদিতার মৃত্যুর পর মায়ের আদর্শে ক্রিস্টিনই বিদ্যালয়ের হাল ধরেছিলেন। স্বামীজীর মৃত্যুর পর রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য নিবেদিতার সঙ্গে রামকৃষ্ণ মঠের দূরত্ব স্থাপন হলেও, শ্রীমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় এতটুকু খামতি পড়েনি। কারণ সে সম্পর্ক ছিল মা-মেয়ের। 


মায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রতিটা দিন নিবেদিতা তাঁর খাতায় লিখে রাখতেন। আর মাও অতি যত্নে নিবেদিতার দেওয়া প্রতিটি উপহার আগলে রাখতেন। তা সে  জার্মান সিলভারের কৌটোই হোক বা এন্ডির চাদর। তা ছিঁড়ে গেলেও তিনি ফেলেননি। বলতেন, ওটা দেখলেই নিবেদিতার কথা মনে পড়ে। এমনই ছিল টান। 


মায়ের আদরের খুকি হতে পেরেছিলেন বলেই বোধ হয়, আয়ারল্যান্ডের মার্গারেট ধীরে ধীরে একাধারে সেবিকা-ভগিনী-মাতা নিবেদিতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। এখানেই মাতৃত্বের সার্থকতা। একাধারে তিনি ধরে রেখেছিলেন রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ভাবাদর্শের রথের রশি, অন্যদিকে সারথি হয়েছেন নারীমুক্তি আন্দোলনের । সন্ন্যাসী ভক্ত হোক বা গৃহী, পুরুষ হোক কিংবা মহিলা - তাঁর মাতৃত্ব হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন। একটি কথায় তিনি বেঁধে রেখেছেন সব সন্তানকে - “জানবে কেউ না থাক, তোমার একজন মা আছেন। আমি মা থাকতে ভয় কি?” 


 তথ্যঋণ: ভগিনী নিবেদিতা , প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা
               বাংলার নারীমুক্তি আন্দোলন এবং শ্রী শ্রী মা সারদাদেবী , সুস্মিতা ঘোষ