কলকাতা: একদিকে বয়ে চলেছে গঙ্গা। তার পাড়ে বিশ্বনাথের বাসস্থান। তাঁর পাশেই দেবী অন্নপূর্ণার অধিষ্ঠান। উত্তর ভারতের এই জনপদ বহু প্রাচীন। বয়ে যাওয়া সময়ের অভিঘাতে চেহারা বদলেছে, কিন্তু এখনও মাহাত্ম্যে একই রয়ে গিয়েছে কাশী-বারণসী।


হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান বারাণসী। বছরভর এখানে ভিড় লেগে থাকে ভক্তদের। ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম ছিল কাশী। প্রাচীনকাল থেকেই কাশী ধর্ম ও শিক্ষার পীঠস্থান। শুধু হিন্দু নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মশিক্ষারও পীঠস্থান এটি। এর অদূরেই রয়েছে সারনাথ, সেটিও পর্যটকদের কাছে বড় আকর্ষণ।


ধর্ম হোক বা ইতিহাস বা নিদেনপক্ষে রকমারি খাওয়া-দাওয়া। বারাণসী সব ধরনের পর্যটকদের কাছেই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। পশ্চিমবঙ্গ থেকে খুব বেশি দূরত্বও নয়। ট্রেনের রাস্তায় মাত্র সাতশো কিলোমিটারের আশপাশে। এক রাতের ট্রেন সফরে পৌঁছে যাওয়া যায় বারাণসী। যাওয়া যায় সড়কপথেও।


এখানে একাধিক স্টেশন রয়েছে। কিন্তু প্রধান স্টেশন বারণসী জংশন। এখান থেকে মূল বারাণসী অনেকটাই। স্টেশন থেকে অটো বা টোটো পাওয়া যাবে গোধূলিয়া চকে পৌঁছনোর জন্য। এটাই মূল কেন্দ্র। গোধূলিয়া চকের কাছেই রয়েছে দশাশ্বমেধ ঘাট। কিন্তু অটো বা টোটো গোধূলিয়া চক পর্যন্তই যায়। শ্রাবণ মাসে পর্যটকদের ভিড় বেশি হয় বলে গোধূলিয়া চকের আরও একটু আগে নামিয়ে দেবে গাড়ি। বাকি রাস্তাটা হেঁটেই যেতে হবে। গোধূলিয়া চক পেরিয়ে রাস্তা সোজা যাচ্ছে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে। সেই রাস্তার দুপাশে অসংখ্য হোটেল এবং দোকানপাট। সেই রাস্তায় উপরেই পড়বে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের সিংহদুয়ার।


মন্দিরে-মন্দিরে:
কাশী বিখ্যাত বিশ্বনাথ মন্দিরের জন্য। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র শৈবতীর্থ এটি, দ্বাদশ জ্য়োতির্লিঙ্গের অন্যতম। তবে হিন্দু ধর্মমতে একটি প্রথা রয়েছে, কাশীতে এসেই প্রথমেই বিশ্বনাথ দর্শন নাকি করতে নেই। কথিত রয়েছে কাশী-বারাণসীর রক্ষাকর্তা বা কোতোয়াল হলেন বাবা কালভৈরব। আগে নাকি সেখানেই পুজো দিতে হয়। সেটা মূল বারাণসী থেকে অনেকটাই দূরে। আগে কালভৈরব মন্দিরে পুজো, তারপর কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির এবং কাছেই সংকটমোচন মন্দিরে পুজো দেওয়াই নাকি নিয়ম। তবে অনেকেই এই প্রথা মানতে পারেন না।


সম্প্রতি কাশী বিশ্বনাথ মন্দির চত্বর ঢেলে সাজানো হয়েছে। নতুন একাধিক ভবন তৈরি হয়েছে। অনেক বড় করে তৈরি করা হয়েছে ৪ নম্বর গেট। এই মন্দির লাগোয়াই রয়েছে জ্ঞানবাপী মসজিদ। কড়া নিরাপত্তা রয়েছে গোটা চত্বর জুড়ে। কাশী বিশ্বনাথ দর্শনের জন্য় একাধিক গেট রয়েছে। সময় বিশেষ সবকটিতে লাইন পড়ে। গোধূলিয়া চক মোড় থেকে যে কাউকে জিজ্ঞেস করবেন চার নম্বর গেটের রাস্তা কোনটি। সেই রাস্তায় একটু হেঁটে গেলেই বাঁ দিকে পড়বে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির কর্তৃপক্ষের অফিস। সুগম দর্শনের জন্য বা রুদ্রাভিষেক পুজো বা অন্য কোনও পুজো সংক্রান্ত বিষয়ে এই অফিসেই টিকিট বুক করা যায়। তবে আলাদা করে বিনা টিকিটে লাইন দিয়ে দর্শনের ব্যবস্থাও রয়েছে। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে রাতের বেলাও দর্শন করা যায়, তুলনামূলক অনেকটাই ফাঁকা থাকে সেই সময়, তবে তখন শুধু দর্শনই হবে, পুজো দেওয়া যাবে না।


কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের পাশেই রয়েছে দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির। কথিত রয়েছে এই মন্দিরও খুব জাগ্রত। আরও একটি বিশয় হল, বারাণসী এসে এই মন্দিরের ভোগ খেতে বলেন অনেকে। প্রতিদিনই অন্নপূর্ণা মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। গোধূলিয়া চক থেকে চার নম্বর গেটের রাস্তার দিকে ঢুকে ডানদিকে রাস্তার উপরেই একটি কানাড়া ব্যাঙ্ক রয়েছে, তার ঠিক পাশের গলি দিয়ে ঢুকেই রয়েছে এই প্রসাদালয়। কাছেই রয়েছে আরও একটি প্রসাদালয়। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ভোগ খাওয়ানোর ব্যবস্থা যেমন রয়েছে, তেমনই অনুদান বা প্রণামী দেওয়ার সুযোগও রয়েছে, যাঁদের সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা দিতেই পারেন। 


বারাণসী মন্দিরে মন্দিরে ছয়লাপ। রাস্তায় উপর, ইতিউতি একাধিক মন্দির রয়েছে যা দেখতে পারেন। একটু দূরে রয়েছে সংকটমোচন মন্দির। ভগবান হনুমানের এই মন্দিরও নাকি খুব জাগ্রত। গোধূলিয়া চক থেকে একটু দূরে থাকা এই মন্দিরে অটো বা টোটো ভাড়া করে যেতে পারেন। ১০০-১২০ টাকা ভাড়া নেবে যদি গোটা টোটো বা অটো বুক করা হয়। মন্দির চত্বর বেশ বড়। দুটি গেট রয়েছে। পুরো গেট দিয়ে ঢুকলে গাছে ঘেরা বিশাল বড় জায়গার ঠিক মাঝ দিয়ে চলা একটি রাস্তা দিয়ে যেতে হবে- ওই রাস্তায় মন ভাল হতে বাধ্য। সেখানে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সংকটমোচন মন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে রাম মন্দিরও। 


ঘাটের শহর বারাণসী:
চওড়া গঙ্গার ঠিক পাশে বারাণসী। আর রয়েছে অসংখ্য ঘাট। গায়ে গায়ে লাগানো ঘাটগুলি পরপর সারি দিয়ে রয়েছে। দশাশ্বমেধ ঘাট বিখ্যাত। রয়েছে মণিকর্ণিকা ঘাট- যা মূলত অন্ত্যেষ্টির জন্য প্রসিদ্ধ। কথিত রয়েছে মনিকর্ণিকা ঘাটে শেষকৃত্য সম্পন্ন হলে আত্মার মুক্তি হয়ে যায়-আর পুনর্জন্ম হয় না। সবসময়েই চিতা জ্বলে এই ঘাটে। শেষকৃত্য সম্পন্ন নয় রাজা হরিশচন্দ্র ঘাটেও। এছাড়াও আসসি ঘাট, মুক্তিঘাট, দ্বারভাঙ্গা ঘাট, হনুমান ঘাট, মুন্সি ঘাট- এরকম অজস্র ঘাট রয়েছে। আর ঘাটের লাগোয়া বাড়িগুলি দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যেতে বাধ্য। বহু পুরনো প্রাসাদগুলির প্রতি কোণায়, বাঁধানো ঘাটের প্রতি ইঞ্চিতে যেন লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাস। বারাণসীতে গেলে নৌকাভ্রমণ অবশ্যই করতে হবে। দশাশ্বমেধ ঘাট, আসসি ঘাট থেকেও এই গঙ্গা ভ্রমণ হয়। ঋতুবিশেষে বদল হয় ভাড়ায়। শেয়ার করলে কম পড়বে, গোটা নৌকা ভাড়া করলে খরচ বেশি হয়। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত নৌকাসফর করতে পারবেন। সেই সফরে চোখ ভরে উপভোগ করতে পারবেন বারাণসীর ঘাটগুলিকে। শীতকালে এখানে হাতে টানা নৌকা চলে কিন্তু বর্ষায় শুধুমাত্র মোটরবোটেই গঙ্গাভ্রমণ হয়। এছাড়া আসসি ঘাটের কাছ থেকে ছাড়ে ক্রুজ--সেটিতেও গঙ্গাভ্রমণ করা যায়, তবে তা বেশ খরচসাপেক্ষ। আসসি ঘাটও বেশ সুন্দর- ওই ঘাটের কাছেই একাধিক ক্যাফে তৈরি হয়েছে। গঙ্গার ঠিক পাশে বসে গল্পগুজব আর খাওয়া-দাওয়ার জম্পেশ সুযোগ রয়েছে।


গঙ্গা আরতির টানে:
বারাণসীর নামের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে গঙ্গা আরতির নাম। বহু পুরনো এই প্রথা। প্রতিদিন সন্ধেবেলায় মা গঙ্গাকে আরতি করা হয়। আর এর টানেই দেশের নানা প্রান্তই শুধু নয়। বিদেশ থেকেও অনেকে আসেন। সূর্যাস্তের পর এই গঙ্গা আরতিতে মুগ্ধ না হতে পারলে বারাণসী আসা বৃথা। মূলত দশাশ্বমেধ ঘাটের গঙ্গাআরতিই সবচেয়ে বিখ্যাত। আসসি ঘাটেও গঙ্গা আরতি হয়। তবে শ্রাবণে বা বর্ষায় বারাণসী গেলে কিন্তু অনেকটাই হাতছাড়া হবে এই সুযোগ। গঙ্গার জলস্তর বেড়ে গেলে ঘাটের উপর গঙ্গাআরতি হয় না। গঙ্গার পাড়ের একটি বাড়িতে ছাদে আরতি হয়। নৌকায় আসন ভাড়া করে নদী থেকে সেই আরতি দেখা যায়। তবে শীতকালে বা বর্ষা ছাড়া অন্য সময় ঘাটের উপরেই ছড়িয়ে হয় সেই আরতি- তা দেখতে আরও অনেক সুন্দর। 


খাওয়া-দাওয়া
প্রাচীন এই জনপদ কিন্তু খাবারের জন্যও বিখ্যাত। এখানে সাধারণত নিরামিষ খাবারই মিলবে। গোধূলিয়া মোড়ের আশেপাশে কিছু ভাল রেস্তরাঁ রয়েছে। রয়েছে বেশ কিছু খাবারের দোকান। কাশী-বারাণসীর খাবার বললেই প্রথমেই মনে পড়ে পেঁড়ার কথা। এখানে রকমারি পেঁড়া পাওয়া যায়। বিশ্বনাথ মন্দিরের সিংহদ্বার দিয়ে ঢুকেই বিশ্বনাথ গলিতে রয়েছে পরপর কটি মিষ্টির দোকান। সেখানেই মিলবে পেঁড়া থেকে শুরু করে রকমারি জিভে জল আনা মিষ্টি। বেনারসের রাবড়িও বিখ্যাত, সারা বারাণসীতে একাধিক দোকানে রাবড়ি পাওয়া যায়। বিশ্বনাথ গলিতে ঢুকেই বাঁ দিকে একটি দোকান রয়েছে। অতি সাধারণ দোকানটির রাবড়ি এবং লস্যি অসাধারণ স্বাদের। বেনারসের কথা আসবে কিন্তু পানের কথা আসবে না এমন তো হবেই না। এখানে কোণে কোণে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক পানের দোকান। সেখান থেকে পছন্দের কোনও পান চেখে দেখাই যায়। এখানে মেলে দুরন্ত সব চাটও। গোধূলিয়া মোড়ের কাছেই কাশী চাট সেন্টার বলে একটি দোকানের কথা নানা জায়গায় মেলে। সেখানে পাওয়া যায় নানা ধরনের মুখরোচক চাট আর শেষপাতে থাকতেই পারে কুলফি।


অলি-গলি-তস্য গলি
ঘুরে দেখতে পারেন বারাণসী শহর। অলি-গলিতে ভর্তি ওই শহর। কোন গলিতে ঢুকে কোন গলিতে বেরোবেন সেটা বোঝা কার্যত অসম্ভব। আদ্যন্ত আধুনিক শহর নয় ঠিকই কিন্তু প্রাচীন শহরের গন্ধ, বহু পুরনো বাড়ির জৌলুস তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার মতো।


বারাণসী এলে একদিন একটা গাড়ি বা টোটো-অটো বুক করে ঘুরে আসতে পারেন বিশ্ব হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং সারনাথ। অনন্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী হওয়া যাবে। 


কোথায় থাকবেন
বারাণসী স্টেশন থেকে শুরু করে গোধূলিয়া চকের আশপাশ, দশাশ্বমেধ ঘাট- সব জায়গাতেই বিভিন্ন দামের হোটেল পাবেন। রয়েছে নানা ধর্মশালা।


যাবেন কীভাবে
হাওড়া স্টেশন থেকে একাধিক ট্রেন রয়েছে যা বারাণসী জংশন স্টেশনে যায়। পাশাপাশি সড়কপথেও যাওয়া যায় বারাণসী। 


আরও পড়ুন: ঘুরে আসি : এল ডোরাডোয় কয়েকদিন