কলকাতা: উচ্চাকাঙ্খা। অবসাদ। মাদকাসক্ত। মদে ডুবে যাওয়া। এ যেন এক সুতোয় বাঁধা। রাগ, অবসাদ, আত্মহত্যা, এসবের সঙ্গেই মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়ছে নেশায় আসক্ত হওয়ার প্রবণতা। আমাদের রাজ্যেই এই প্রবণতা কার্যত মহামারির আকার নিচ্ছে। আর তার জন্য প্রাথমিকভাবে মনোবিদরা দায়ী করছেন যুব সমাজের উচ্চাকাঙ্খা এবং সেই কাঙ্খিত স্বপ্নে পৌঁছতে না পেরে অবসাদে চলে যাওয়া-কে। আর সেখান থেকেই আত্মহত্যার চেষ্টা কিংবা মদে আসক্তি। এই সমস্যা ২৫ থেকে ৩৫ বছরের যুবক, যুবতীদের মধ্যে সবথেকে বেশি। কলকাতা সহ রাজ্য জুড়েই চেহারাটা একই। তবে রাজধানীতে সংক্রমণটা যেন তুলনায় বেশি।
কর্পোরেট সংস্কৃতি যেভাবে কলকাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করেছে তাতে অশনি সংকেত আরও বাড়ছে। ডঃ রিয়াল দাস যেমন বলছেন, “সম্প্রতি শহর কলকাতায় কর্পোরেট চাকুরিজীবীদের মধ্যে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ার প্রবণতা অকল্পনীয়ভাবে বাড়ছে। ২৫ থেকে ৩৫ বছরের যুবদের মধ্যে মারিজুয়ানা, অ্যালকোহল অ্যডিকশন যে পরিমাণে বেড়েছে তা সত্যিই আশঙ্কার।” মার্কিন প্রতিষ্ঠান জেনি ক্রেগের প্রাক্তন হেলথ ও ওয়েলনেস কনসালট্যান্ট রিয়াল নিজের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে গিয়ে বললেন, “মানসিক স্বাস্থ্য বর্তমান সময়ে একটি গ্লোবাল ক্রাইসিসের আকার নিয়েছে। শুধু চাকুরিজীবী নয়, শিশুমনন নিয়েও চিন্তার কারণ রয়েছে। বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক, শিক্ষিকাদের বেশিরভাগই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন নন। কোনও একজন শিশুর প্রতি বিশেষ মনোযোগ অন্য শিশুর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে”। এখানেই শেষ নয়, ডঃ রিয়ালের কাছে এমনও অনেক মনোরোগীরা এসেছেন যারা ‘অফিস রাজনীতি’-তে সমস্যায় পড়েছেন।
সম্প্রতি এসএসকেএম হাসপাতালে একটি মেলার আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে বিনামূল্যে মানুষের মনের চিকিৎসার পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। মেলার পোশাকি নাম ‘মনের মেলা’। অধ্যাপক ডঃ প্রদীপ কুমার সাহার তত্ত্বাবধানে রাজ্য সরকারের সহায়তায় এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অধ্যাপক ডঃ প্রদীপ কুমার সাহার কথায়, “প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বে একজন করে আত্মহত্যা করছেন। এর অন্যতম কারণ অবসাদ। আমাদের দেশেই শুধু নয়, মানসিক অবসাদ নিয়ে চিন্তিত আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘হু’-ও। দেশে স্বাস্থ্য সচেতনতা তলানিতে, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতার চেহারা আরও কদর্য।” জ্বর-সর্দি-কাশির মতোই ‘অবসাদ’-ও একটা রোগ এবং সেটা চিকিৎসা দিয়েই সাড়ানো সম্ভব, মত ডঃ সাহার। প্রসঙ্গত, শুধু মেলা-ই নয়, এসএসকেএম-এ একটি শিক্ষাশিবিরেরও আয়োজন করা হয়েছে, যেখান আত্মহত্যা প্রতিরোধ, কীভাবে অবসাদজনিত রোগের মোকাবিলা করতে হবে এমন অনেক বিষয়েই দেশ-বিদেশের একাধিক চিকিৎসক, অধ্যাপকরা বক্তব্য রেখেছেন।
(মনের মেলায় বক্তব্য রাখছেন অধ্যাপক ডঃ প্রদীপ কুমার সাহা)
দড়ি দেখলেই আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করছে! ট্রেন লাইন দেখলেই ঝাঁপ মারতে ইচ্ছে করছে! পড়াশুনায় মন বসছে না। একাকিত্ব। এমন আরও অনেক সমস্যা নিয়েই এই মেলায় এসেছেন অনেকে। ভূগোল নিয়ে পড়ছে, বাগবাজার উইম্যানস কলেজের এক ছাত্রীই যেমন তাঁর অত্যাধিক রাগ এবং হতাশার সমস্যা জানালেন। ছেলের আইকিউ কম, অতি সরল, টাকা পয়সার হিসেব রাখতে পারে না, এই সমস্যা নিয়েও মেলায় এসেছেন কলকাতার এক দম্পতি। হ্যাপি মাইন্ডসের কর্মী অবিনাশ ভান্ডারি যেমন বললেন, “ছেলেমেয়ে বেশি মোবাইল ঘাঁটছে। সিরিয়াল দেখছে। এমন একাধিক সমস্যা নিয়ে মা-বাবারা এই মেলায় এসেছে। তাছাড়া টিনেজদের মধ্যে প্রেম-বিচ্ছেদ থেকে হতাশার মতো ঘটনাও রয়েছে। এমনকি বিবাহিতরাও তাঁদের পারিবারিক সমস্যা নিয়ে এখানে এসেছেন।” তাঁর কথায়, সমাজে মানসিক রোগ মানেই ‘পাগল’ বলে চিহ্নিত করার ট্যাবু রয়েছে। অনেক শিক্ষিত মানুষও মনোবিদদের ‘পাগলের ডাক্তার’ বলেন। এই ধ্যানধারণা না বদলালে সমস্যার সমাধান তো হবেই না উল্টে বাড়বে। প্রয়োজন মানুষের সঙ্গে কথা বলা। আর সেটা করলেই দূর হবে মনের দ্বন্দ্ব।