কলকাতা: ১২ দিনের জ্বর। শ্বাসকষ্ট প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল। শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। স্বাভাবিক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছিল শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রিপোর্ট বলল, কোভিড পজিটিভ। আসল লড়াইটা শুরু তারপর থেকেই।


চড়ছে করোনা গ্রাফ। সারা বিশ্বের সঙ্গে এই রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি প্রতিদিনই ভয়াবহ চেহারা নিচ্ছে। তবে এরই মধ্যে আশার আলো জাগিয়ে বাড়ছে সুস্থতার হার।
প্রথম থেকেই সমীক্ষা বলছিল, করোনায় বেশি ঝুঁকি প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধদেরই। সহ-অসুস্থতা থাকলে করোনা চিকিৎসা আরও কঠিন হয়ে পড়ে, এ কথা বলে আসছেন সব বিশেষজ্ঞরাই। তবে সব প্রতিকূলতাকে হারিয়ে দিতে পারে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা, এমনটা আবারও প্রমাণিত হল এই শহরের হাসপাতালেই।

সময়টা মে মাসের মাঝামাঝি। ৫৪ বছরের পেশায় দুধ ব্যবসায়ী এই ব্যক্তির জ্বর আসে। সাধারণ জ্বর মনে করে প্রথম কয়েকদিন আলাদা করে কোনও চিকিৎসা হয়নি। ১০ দিন কেটে গেলেও যখন জ্বর ছাড়়েনি তখনই মেডিকা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে।

‘জ্বর, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। এই দুই উপসর্গ দেখেই ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন বাবার কোভিড পজিটিভ হলেও হতে পারে। দুদিনের মাথাতেই জানা যায়, বাবার করোনা হয়েছে। আমরাও তখন হোম কোয়ারেন্টিনে। এদিকে বাবার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। ডাক্তারবাবুরা জানালেন শুধু ভেন্টিলেশনে কাজ হবে না। তাহলে? পুরো কথাবার্তাই চলছিল ভিডিও কলে। ডাক্তারবাবুরা বারবার যোগাযোগ করছিলেন। ’, বলছিলেন করোনা আক্রান্তর ছেলে রাহুল রয়।

ওই ব্যক্তির অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল। শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহও কমছিল। সমস্যা হচ্ছিল কিডনিতেও। এই অবস্থায় ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিয়েও কাজ হয়নি। দরকার ছিল একমোর। জানালেন হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ও একমো বিভাগের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক দীপাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়।

একমো কী, এই বিষয়টাই তো অনেকেই জানেন না। ফুসফুস, হদপিণ্ড যখন স্বাভাবিক কাজ করা বন্ধ করে দেয়, যখন ভেন্টিলেশন দিয়েও কাজ হয়না, তখন একমো দিয়ে শরীরের সেই নির্দিষ্ট অর্গ্যানকে বিশ্রাম দেওয়া হয়। তবেই সেই রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষীণ আশা থাকে। এই করোনা রোগীর ক্ষেত্রেও হয়ে ছিল ঠিক তেমনটাই।

চিকিৎসক কুণাল সরকারের নেতৃত্বে হাসপাতালের একমো টিম দিবারাত্র চিকিৎসা চালিয়ে গিয়েছিল  ওই ব্যক্তির। মাঝে তো কিডনি, ফুসফুসের সঙ্গে মস্তিষ্কে করোনার প্রভাব দেখা দিয়েছিল। যে কারণে চিকিৎসায় সাড়া দিতে বেশ দেরিই করছিলেন ওই ব্যক্তি। এই অবস্থায় টানা ১২দিন একমো চলে।

কোনও ব্যক্তির একমো হওয়ার অর্থ একসঙ্গে দুজন রোগীর প্রতি নজর রাখার সামিল। একমো মেশিনেরও তো একজন মানুষের মতোই বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে। সেটা ঠিক মতো কাজ করছে কিনা, সেটাও পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হয়। এক মুহূর্তের ত্রুটি বিচ্যুতি বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। জানালেন একমো টিমের অন্যতম সেনানি ডা. অর্পণ চক্রবর্তী।

কার্ডিয়াক আইটিইউয়ের নার্সিং টিমের সুপারভাইসর দীপামল সুরেন্দ্রন জানালেন, প্রতি শিফটে দুজন করে নার্স অতি সতর্ক থাকতেন। রোগীর ডায়ালিসিসও চলছিল।
এই কঠিন অবস্থা থেকে অবশেষে সাড়া দিতে শুরু করেন রোগী। ঠিক এক মাসের মাথায় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান তিনি।

এখনও চলছে ডায়ালিসিস। বাড়িতেই পর্যবেক্ষণ রাখা হচ্ছে তাঁকে। জানালেন রোগীর বাড়ির লোকেরা।

‘কোভিড পরিস্থিতি যখন খারাপের দিকে যাচ্ছে্, তখনই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, ১০-১২ টি একমো মেশিন তিনি অর্ডার করছেন। করোনা চিকিৎসায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এই যন্ত্রটি, তা এখন প্রতি মুহূর্তেই বোঝা যাচ্ছে। তাই বড় ধন্যবাদ ওঁর প্রাপ্য।’, বলা হয়েছে হাসপাতালের একমো টিমের তরফে।

৫৪ বছরের এই রোগীর চরম সঙ্কটের মুখ থেকে ফিরে আসা, ঠিক যেন সত্যি রূপকথা। রাজ্য জুড়ে করোনা আতঙ্কের মধ্যেই আশার আলো এই ঘটনা।