কলকাতা: বাড়ি কলকাতার (Kolkata) হিন্দুস্তান পার্কে (Hindustan Park)। ১৮ বছর আগে ডাক্তারি পড়ার জন্য গিয়েছিলেন ইউক্রেনে (Ukraine)। তারপর থেকে সেখানেই আছেন চিকিৎসক, অধ্যাপক পৃথ্বীরাজ ঘোষ। যুদ্ধের (Russia-Ukraine War) মধ্যেও তিনি কিভে (Kyiv) নিজের বাড়িতেই আছেন। অনেকেই অন্য শহরে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, কিন্তু কিভ ছাড়তে নারাজ এই বাঙালি চিকিৎসক। কারণ, তিনি তিনটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যদের সাহায্য করে চলেছেন তিনি।


কিভ থেকে ফোনে এবিপি লাইভকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে পৃথ্বীরাজ জানালেন, ‘১৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইউক্রেন আক্রমণ করবে রাশিয়া। তখনই আমি ছাত্রদের দেশে ফিরে যেতে বলি। কিন্তু ওরা তখনই দেশে ফিরতে রাজি হয়নি। ওরা বলে, এখন বিমানের টিকিটের দাম ৭০-৮০ হাজার টাকা। ৬ মার্চ এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম দেখাচ্ছে ২৫ হাজার টাকা। ওরা সেই সময় দেশে ফিরবে। যুদ্ধ হলে কিছু পাওয়া যাবে না, এই আশঙ্কায় আমি আগেই চাল-ডালের অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। সেগুলো ২১ ফেব্রুয়ারি চলে আসে। ২৪ তারিখ যখন রাশিয়া গোলাবর্ষণ শুরু করে, তখন আমি সুমি শহরে ছিলাম। যুদ্ধের বিষয়ে তখনও পর্যন্ত আমার কাছে কোনও খবর ছিল না। আমার কাজ সেরে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত দেড়টা নাগাদ আমার ছাত্ররা ফোন করে বলে, বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমি তখনও কিছু বুঝতে পারিনি। ছাত্রদের বলি, হয়তো টেকনিক্যাল কারণে বিমানবন্দর বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু আমার সেই ধারণা যে ভুল ছিল, সেটা ভোরবেলা বুঝতে পারি। ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এক পরিচিত ভদ্রলোক ফোন করে বলেন, রাশিয়া আক্রমণ করেছে। আমার ছাত্ররা বাসে করে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে চাইছে, কিন্তু ওদের বাস আটকে দেওয়া হয়েছে। আমার ছাত্রদের ভাষা সমস্যা হচ্ছে। আমি যদি ওদের হয়ে অনুবাদ করে দিই, তাহলে সুবিধা হয়। আমার ছাত্ররা তখন কিভ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে ছিল। আমি তখনকার মতো ওদের সাহায্য করি। সেই রাতেই ট্রেন ধরে কিভে আমার বাড়িতে ফিরে আসি। তারপর যুদ্ধের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারি। তখন থেকে শুধু ভারতই নয়, অন্য দেশগুলির পড়ুয়াদেরও নিরাপদে কিভ ছাড়তে সাহায্য করি। আমার কোনও ছাত্রই আর কিভে নেই। সবাই অন্যত্র চলে যেতে পেরেছে।’




এখন কিভের পরিস্থিতি কী? দিন কাটছে কীভাবে? পৃথ্বীরাজ জানালেন, ‘আমি রোজ সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে যাই। আমি রেডক্রসের সঙ্গে যুক্ত। তাই এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষজনকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। তবে বেশিক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকতে পারি না। কারণ, সন্ধে ৬টা থেকে কার্ফু। আমি দুপুরের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসি। তারপর ফোনেই সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। আমি যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই চাল-ডাল অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম বলে কিছুদিন চলবে। না হলে সমস্যায় পড়তাম। কারণ, এখন সুপারমার্কেটে কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। পেট্রোল পাম্পে তেল-গ্যাস নেই, এটিএমে টাকা নেই। এমনকী, কারও কাছে ডলার, ইউরো, পাউন্ড থাকলেও, সেগুলো ভাঙানোর উপায় নেই। এমনিতেই ২০১৪ সালের পর থেকে ইউক্রেনের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। ২০১৪ সালের আগে ইউক্রেনের অর্থনীতি রাশিয়ার চেয়েও ভাল ছিল। সেই সময় এখানকার ১০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে এক সপ্তাহ চালানোর মতো জিনিসপত্র নিয়ে আসা যেত। এখন হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলেও, এক থেকে দেড় দিন চালানোর মতো জিনিস পাওয়া যায়। সারা দেশেই চূড়ান্ত সঙ্কট।’


আরও পড়ুন : চোখের সামনে কেবল মৃত্যু! প্রাণে বেঁচে ফেরা ছেলেকে পেয়ে কান্নায় ভাঙলেন মা


যুদ্ধে কোন পক্ষ জয় পাবে? ইউক্রেন কি প্রবল শক্তিধর রাশিয়ার সামনে প্রতিরোধ বজায় রাখতে পারবে? পৃথ্বীরাজ জানালেন, ‘ক্রেমলিনের পরিকল্পনা ছিল, ২৭ তারিখের মধ্যেই ওরা কিভ দখল করে নেবে। কিন্তু ওদের যে এতটা প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে, সেটা বুঝতে পারেনি। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট দেশপ্রেমিক। এখানকার সবাই তাই। ইউক্রেনের বেশিরভাগ মানুষেরই সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া থাকে। তাই প্রেসিডেন্ট যখন দেশের সব নাগরিককে অস্ত্র হাতে লড়াই করার আহ্বান জানান, তখন সবাই এগিয়ে আসেন। আমি একদিন বাসে করে একটা কাজে যাচ্ছিলাম। সেই বাসে আমি একাই বিদেশি ছিলাম, বাকি সবাই ছিলেন ইউক্রেনের নাগরিক। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই বয়স্ক। একটা সামরিক ঘাঁটির কাছে বাস থামতেই দেখলাম সবাই নেমে গেলেন। ওঁরা দেশরক্ষার জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষও লড়াই শুরু করায় সমস্যায় পড়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। ওরা শুরুতেই মারিউপোলে জল প্রকল্প ধ্বংস করে দেয়। ২৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকে রাশিয়ার সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালাতে শুরু করেছে। বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়া শুরু হয়েছে। এই হামলায় বহু মহিলা, শিশুরও মৃত্যু হয়েছে।’


 


যে ভারতীয় পড়ুয়ারা ইউক্রেনে পড়তে গিয়েছিলেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ কী? এই বাঙালি চিকিৎসক বলছেন, ‘আমার ধারণা, রাশিয়া ইউক্রেন দখল করবে না। ওরা শুধু নিজেদের সীমান্তটা আরেকটু বাড়িয়ে নিতে চাইছে। তবে রাশিয়া যদি ইউক্রেন দখলও করে, তাতেও পড়ুয়াদের চিন্তা নেই। যুদ্ধ শেষ হলেই ওরা ফিরে এসে পড়াশোনা শেষ করতে পারবে। ২০১৪ সালের যুদ্ধের সময়ও দেখেছি, শুধু প্রশাসনেই বদল আসে, বাকি সব এক থাকে। রেক্টর, অধ্যাপক, কর্মীরা আগের মতোই থাকেন। ফলে পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ত। এতদিন ওরা ইউক্রেনের শিক্ষামন্ত্রকের সার্টিফিকেট পেত, রাশিয়া যদি ইউক্রেন দখল করে নেয়, তাহলে ওরা রাশিয়ার শিক্ষামন্ত্রকের সার্টিফিকেট পাবে।’


আরও অনেকের মতোই পৃথ্বীরাজও এখন যুদ্ধ থামার অপেক্ষায়। তাঁর আশা, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানসূত্র পাওয়া যাবে।