'করোনা পরিস্থিতিতে পুজোর আড়ম্বর নয় বন্ধ রাখা হল, কিন্তু পুজোর অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত এতজন শিল্পী, এঁদের কী হবে? পেট চলবে তো? ', চিন্তার ভাঁজ প্রখ্যাত শিল্পী ভবতোষ সূতারের কপালে।
শিল্পী ভবতোষ সূতার
'আমাদের ওয়ার্কশপটা অনেকটা দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টের মতো। সারাবছর কাজ চলে। তারই ফলশ্রুতি আপনারা দেখতে পান পুজোর ৫দিন। অন্য বার এই সময় পুজোর কাজের পিক আওয়ার। আর এবছর...', বলছিলেন শিল্পী।
এই বছর নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ ও সুরুচি সঙ্ঘের দায়িত্ব তাঁর, কলকাতার বড় ব্যানারের পুজোগুলির অন্যতম এই দুটি। আড়ম্বর, বাজেট, থিমের নিরিখে এগিয়ে থাকা এই দুটি পুজোর কাজের গতিতে আপাতত রাশ টানতে হয়েছে । করোনা পরিস্থিতিতে পুজো না হলে বরং আরও বড় ক্ষতি অপেক্ষা করে আছে। মনে করছেন ভবতোষ।
'একটা পুজোয় নানা ধরনের মানুষ জড়িয়ে থাকেন। বড় শিল্পী, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী, ছাত্র-ছাত্রী ও একদম গ্রামের চাষের কাজ করা লোক। এঁরা সাধারণত চাষ দিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। পুজোর মরসুমে তিন মাস কাজ করে হাতে কাঁচা টাকা নিয়ে ফিরে যান। পরিবারের মুখে হাসি ফোটান। এদের কী হবে! যাদের সারাবছরের অন্নসংস্থান একটা পুজোর উপরই নির্ভর করে থাকে, তাদের পেটের ভাতই বা জুটবে কীভাবে?'
পরিস্থিতি কঠিন হলেও, সরকার যেন ছোট করে হলেও পুজো করার অনুমতি দেন। তাতে বাজেট ছোট হলেই সেই অনুসারে থিম ঠিক হবে। এটাই তো একজন বড়শিল্পীর কাছে প্রকৃত চ্যালেঞ্জ। সীমিত বাজেটে কীভাবে অনন্য শিল্প তৈরি করা যায়। এই বছরটাতেই বরং চেষ্টা করা হোক কম বাজেটের থিমে সবথেকে বেশি মানুষকে কাজে লাগানো। তাহলে অনন্ত এই গরিব মানুষগুলোর সুরাহা হবে। ১৫ দিন সময় পেলেও নতুন কিছু করে দেখাতে পারব, কিন্তু এই শিল্পের মহোৎসব যেন বন্ধ না হয়, বলছিলেন শিল্পী ভবতোষ।
মণ্ডপ হোক না ঘাস-পাতা দিয়ে কিংবা রিসাইকল করা উপকরণ দিয়ে, তাই দিয়ে সেরা কাজটা হোক। উৎসব বা পুজো যদি মানুষের কাজেই না লাগে, তবে কী লাভ, মত শিল্পীর।
আবার কলকাতার অন্যতম স্বনামধন্য শিল্পী পার্থ দাশগুপ্ত ভাবছেন অন্য কথা। তিনি নিজে থিম নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকেন। কিন্তু সারা বাংলার নিরিখে থিম পুজোর সংখ্যা কটা?
শিল্পী পার্থ দাশগুপ্ত
'রাজ্যে প্রায় ৩০ হাজার পুজো হয়। শহরে ২ হাজারের আশেপাশে। এর মধ্যে ভাল থিমের পুজো দুশো থেকে আড়াই শো। কিন্তু ভাবুন, গ্রামবাংলায় যে লোকটা প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধে আর শহরেও যে প্যান্ডেল করছে, তারা তো আলাদা নয়। পুজো বন্ধ হলে তারা খাবে কী? এরাই বৃহত্তর ইকোনমি। এরাই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আনস্কিলড শ্রমিকরা অন্যকিছু কাজ জুটিয়ে নিতে পারবে হয়ত। কিন্তু যে লোকটা দুর্গা ঠাকুরের সাজ তৈরি করে, কেউ চালচিত্র করে, কোনও একটা গ্রাম প্রতিমার চুল প্রস্তুত করে, তাদের কী হবে, পুজো বন্ধ হলে?'
প্রশ্নের মুখ পুজো করার টাকার যোগানও। শহরের সব বড় ক্লাব পুজোর খাতের টাকা থেকেই হয়ত করোনা পরিস্থিতিতে ত্রাণ দিচ্ছে গরিব মানুষদের। তাদেরও তো পুঁজিতে টান পড়বে। আবার এই টানাপোড়েনের সময় স্পনসররাই বা টাকা ঢালবেন কীভাবে, প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে অনেক। বলছিলেন শিল্পী।
কিন্তু সবথেকে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সোশ্যাল ডিসট্যানসিং। দূরত্ব বজায় রেখে কীভাবে হবে দুর্গা পুজো? সেটাই এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন। যার উত্তর শুধু ভবিষ্যতই দিতে পারবে।