মুম্বই: দুপুর পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সম্ভাব্য বোর্ড প্রেসিডেন্ট। সন্ধ্যার পর পট পরিবর্তন। আচমকাই দৌড়ে এগিয়ে যান ব্রিজেশ পটেল। রাতে ফের রুদ্ধশ্বাস মোড়। রবিবার গভীর রাতে জানা যায় যে, শেষ পর্যন্ত বোর্ড প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ই। ক্রিকেটীয় প্রত্যাবর্তনের মতোই নাটকীয় হয়ে রইল দেশের ক্রিকেট প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে সৌরভের মনোনয়ন পেশও।


কিন্তু কী কারণে ফেভারিট হিসাবে শুরু করেও পিছিয়ে পড়েছিলেন সৌরভ? কোন অঙ্কেই বা শেষ মুহূর্তে মহারাজকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটালেন?

বোর্ড সূত্রে খবর, শনিবার নয়াদিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর সঙ্গে বৈঠক করেন সৌরভ। ঘটনা হচ্ছে, অমিত শাহর পুত্র এবং গুজরাত ক্রিকেট সংস্থার শীর্ষকর্তা জয়-ও ছিলেন বোর্ডের মসনদের লড়াইয়ে। গত প্রায় এক দশক ধরে দেশের ক্রিকেট বোর্ডের যে কোনও বড় সিদ্ধান্তে অরুণ জেটলির মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু জেটলির প্রয়াণের পর অমিতের কাছে দরবার করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না প্রেসিডেন্ট পদের জন্য মরিয়া সৌরভের। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, অমিতের সঙ্গে শনিবার ইতিবাচক আলোচনাই হয়েছিল সৌরভের। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি সৌরভকে আশ্বস্ত করেন যে, তিনিই সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট। আর জয় হবেন সচিব পদপ্রার্থী। সেই সঙ্গে বিজেপির হাইকম্যান্ড থেকে বোর্ডের নির্বাচনপর্ব তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রাক্তন বোর্ড প্রেসিডেন্ট তথা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরকে।

শনিবার রাতে বিমান বিভ্রাটে দিল্লিতে আটকে পড়ায় রবিবার সকালেই মুম্বই পৌঁছন সৌরভ। সেখানেই বেসরকারিভাবে বোর্ডের সমস্ত সংস্থার কর্তাদের বৈঠক করার কথা ছিল। ঘটনা হচ্ছে, মুম্বইয়ে কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই হাওয়া ঘুরতে শুরু করে। প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আচমকাই দৌড়ে এগিয়ে যান ব্রিজেশ পটেল। যিনি বিতর্কিত প্রাক্তন বোর্ড প্রেসিডেন্ট নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের পছন্দের প্রার্থী। শোনা যায়, সৌরভকে নাকি প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং তাতে রাজি না হওয়ায় পরে আইপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। যদিও কোনওটিতেই রাজি হননি জাতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক।

কিন্তু কী কারণে পটবদল? কোনও কোনও মহল থেকে বলা হতে থাকে যে, অমিত হয়তো তাঁকে বোর্ড প্রেসিডেন্ট করার পরিবর্তে বিজেপির হয়ে প্রচারে নামার শর্ত দিয়েছিলেন। সৌরভ রাজি হননি। বলা হচ্ছে, সক্রিয় রাজনীতিকে বরাবরই এড়িয়ে চলেছেন সৌরভ। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক এবং জগমোহন ডালমিয়ার প্রয়াণের পর নবান্ন থেকে তাঁকে সিএবি প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করার মতো ঘটনার পরও সৌরভ তৃণমূলের হয়েও কখনও প্রচার করেননি। তাই তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, বিজেপি হাইকম্যান্ড তাঁকে কোনও রাজনৈতিক প্রস্তাব দিলেও রাজি হওয়া সম্ভব ছিল না সৌরভের পক্ষে।

সৌরভ ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বোর্ড কর্তা জানিয়েছেন যে, বিকল্প কোনও পদের জন্য রাজি হওয়ার প্রশ্নই ছিল না। কারণ, বোর্ড প্রশাসনে এলেই সিএবি প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়তে হবে সৌরভকে। পাশাপাশি স্বার্থের সংঘাত এড়াতে ধারাভাষ্যকার, আইপিএলে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের মেন্টরের পদ এবং কলাম লেখার কাজও ছাড়তে হবে। সব মিলিয়ে প্রায় ৫ কোটি টাকারও বেশি অঙ্কের ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। বলা হচ্ছে, এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতি মেনে নিয়ে আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বা বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্টের মতো কোনও কম তাৎপর্যপূর্ণ পদে যেতে রাজি ছিলেন না সৌরভ নিজেও। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্রিকেটের জন্য যে কাজ তিনি করতে পারবেন, বাকি কোনও পদে থেকেই সেভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।

তাহলে কোন অঙ্কে বাজিমাত? জানা গিয়েছে, মুম্বইয়ে রবিবার রাতে অনুরাগ ঠাকুর নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন। সেখানেই বোর্ড কর্তাদের বড় একটা অংশ ব্রিজেশকে নিয়ে তাঁদের আপত্তির কথা তোলেন। বলা হতে থাকে, গড়াপেটা কেলেঙ্কারিতে বিদ্ধ ভারতীয় ক্রিকেটের ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন অধিনায়ক সৌরভ। ভারতীয় ক্রিকেট যখন আইপিএল গড়াপেটা আর সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত লোঢা কমিটির ধাক্কায় নতুন করে বেসামাল, তখন হাল সামলানোর জন্য সৌরভের চেয়ে যোগ্য প্রার্থী কেউ হতে পারে না। ব্রিজেশ প্রাক্তন ক্রিকেটার। কর্নাটক ক্রিকেট সংস্থার প্রশাসক হিসাবে ভাল কাজ করেছেন। তবে সৌরভের ক্রিকেটীয় প্রোফাইলের সঙ্গে তাঁর কোনও তুলনাই চলে না।

পাশাপাশি কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে, ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করছে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। তাই সৌরভকে হাতে রেখেই এগনোর অঙ্ক কষা হয়েছে। সেই কারণেই রাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতি টের পেয়েই নাকি অনুরাগের কাছে বিজেপি হাইকম্যান্ডের ফোন আসে। তারপরই সৌরভের পক্ষে নাটকীয় প্রত্যাবর্তন। এবং বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পেশ। সচিব পদে ক্ষমতায় আসতে চলেছেন জয় শাহ।

দশ মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না সৌরভ। লোঢা সুপারিশ মেনে আগামী জুলাইয়ে রাজ্য ও বোর্ড মিলিয়ে ক্রিকেট প্রশাসনে ছয় বছর কাটিয়ে ফেলার পর তাঁকে কুলিং অফ-এ যেতে হবে। তিন বছর পর ফের তিনি ক্রিকেট প্রশাসনে ফিরতে পারবেন। তবে সৌরভ নিজে মেয়াদ নিয়ে অত ভাবতে রাজি নন। কম সময়েও ক্রিকেট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করতে চান।

৬৫ বছর পর কোনও প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার পূর্ণ সময়ের জন্য বোর্ডের সর্বোচ্চ পদে আসছেন। ১৯৫৪-১৯৫৬ সালে বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজা কুমার। মাঝে শিবলাল যাদব ও সুনীল গাওস্কর অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তবে সৌরভের হাত ধরেই নতুন দিগন্তের সূচনা হতে চলেছে দেশের ক্রিকেটে।

বদলে যেতে চলেছে সিএবি-র সমীকরণও। সৌরভ বোর্ড প্রেসিডেন্ট হলে সিএবি সভাপতির পদ ছাড়তে হবে তাঁকে। কে হবেন সিএবি-র পরবর্তী প্রেসিডেন্ট? দৌড়ে এগিয়ে জগমোহন ডালমিয়ার পুত্র অভিষেক। বঙ্গ ক্রিকেটের কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে, সৌরভের দাদা ও প্রাক্তন ক্রিকেটার স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ও প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। সিএবি-র প্রাক্তন সচিব বাবলু কোলেও দৌড়ে রয়েছেন।

আপাতত দশ মাসের জন্যই ক্রিজে থাকবেন সৌরভ। তার পর চলে যেতে হবে বাধ্যতামূলক ‘কুলিং অফে’। এখনকার মতো বঙ্গ ক্রিকেট মহল তো বটেই, গোটা দেশেই ক্রিকেট প্রশাসক সৌরভকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন। অধিনায়ক হিসেবে যাঁর হাত ধরে ম্যাচ গড়াপেটার কালো অধ্যায় থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট, তিনিই এ বার বোর্ডের নতুন রাজা।