নয়াদিল্লি: বৈঠকের লক্ষ্য ছিল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে সমস্ত বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করা। যদিও রাজধানীতে সনিয়া গাঁধীর ডাকা সেই বৈঠকে অনৈক্যের ছবিটাই যেন অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেল।


সনিয়ার ডাকা বৈঠকে গরহাজির রইল একাধিক মোদি বিরোধী দল! মোদি সরকারের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় রণকৌশল স্থির করতে দিল্লিতে ডাকা এই বৈঠকে অনুপস্থিতদের মধ্যে প্রধান দুই মুখ হলেন তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং উত্তরপ্রদেশের বহুজন সমাজ পার্টির সভানেত্রী মায়াবতী। এর পাশাপাশি সোমবারের বৈঠকে ছিল না অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি, এম কে স্ট্যালিনের ডিএমকে ও উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা।

লোকসভা ভোটের পরই, মোদি-বিরোধিতার অবস্থান থেকে অনেকখানি সরে এসেছেন মায়াবতী। তিন তালাক, জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপের মতো মোদি সরকারের একাধিক সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। কংগ্রেস সাংসদ পি চিদম্বরমের গ্রেফতারির পর বিরোধীরা যখন একজোটে বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ তুলছে, তখন আগাগোড়া নীরব থেকেছেন বহেনজি। সম্প্রতি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় তাঁর নিজের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ অগ্নিগর্ভ চেহারা নিলেও, মায়াবতী এই ইস্যুতে মুখই খোলেননি। সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের শপথ গ্রহণেও বিরোধী ঐক্যের ছবির পাশাপাশি মায়াবতীর অনুপস্থিতিও সকলেরই চোখে পড়েছিল।

কিন্তু, আচমকা মায়াবতীর এই ভোলবদলের কারণ কী? পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, এর নেপথ্যে রয়েছে সিবিআই-জুজু। মায়াবতীর ভাই আনন্দ কুমারের বিরুদ্ধে বেনামি সম্পত্তির তদন্ত করছে আয়কর দফতর। যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির জন্য জমি কেনায়, দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তাতে নাম রয়েছে উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিরোধিতা করলেই ফের সিবিআই-আয়কর দফতর সক্রিয় হয়ে উঠবে, এই আশঙ্কাতেই মুখে কুলুপ এঁটেছেন বিএসপি সভানেত্রী।

আর দিল্লিতে বিরোধীদের বৈঠকে মায়ার মতো মমতার অনুপস্থিতির নেপথ্যেও একই কারণ কারণ দেখছেন অনেকে। শুরুতে বৈঠকে যোগ দেবেন বলে ঠিক থাকলেও, পরে সিদ্ধান্ত বদলান তৃণমূলনেত্রী। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি টেনে আনেন বাম-কংগ্রেসের ধর্মঘটের কথা। যদিও, সিপিএম-কংগ্রেসের কটাক্ষ, মাথার ওপর সারদা-নারদকাণ্ডের খাঁড়া ঝুলছে বলে, কলকাতায় মোদির সঙ্গে বৈঠক করলেও, দিল্লিতে বিরোধীদের বৈঠকে গরহাজির তৃণমূলনেত্রী।

সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী কটাক্ষের সুরে বলেছেন, ‘এটা একটা বাহানা। উনি বিরোধীদের এক হতে দিতে চান না। যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তারপর দিন আর কী করে যাবেন। মাসখানেক হয়ে গেলে হয়ত যেতেন।’ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস বিধায়ক আব্দুল মান্নান বলেছেন, ‘সর্বভারতীয় নেতৃত্ব বুঝে গেছে মমতাকে ভরসা করলে চলবে না। এই আন্দোলন লোক দেখানো। মোদিকে সত্যি যদি বলে থাকেন, তাহলে মোদি উত্তরে কী বলেছেন, সেটা বলুন।’

যদিও তৃণমূল এসবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে, মমতা আগেই বলেছেন, সিপিএম-কংগ্রেস একযোগে তৃণমূলকে আক্রমণ করছে। ওরা আগে ঠিক করুক কে প্রতিপক্ষ।

দিল্লিতে বিরোধীদের বৈঠকে সনিয়া কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে তীব্র আক্রমণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘দেশে যা হচ্ছে, তা নিয়ে নিজেদের মত বিনিময় করার জন্য এই বৈঠক। কেন্দ্রীয় সরকার নিপীড়ন আর শোষণের নীতি নিয়েছে। মানুষের মধ্যে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। বিভাজন ঘটাচ্ছে। গোটা দেশে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।’

সংবিধানকে অবহেলা করা হচ্ছে বলেও তোপ দাগেন সনিয়া। বলেন, ‘প্রশাসনিক কাঠামোর অপব্যবহার করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। তাঁরা পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করছেন এবং উস্কানি দিচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশে আমজনতাকে হেনস্থা করা হচ্ছে।’ ছাত্র ও যুবসমাজকে নিশানা করা হচ্ছে বলেও আক্রমণ করেন কংগ্রেসের অন্তর্বর্তী সভানেত্রী। সনিয়া বলেন, ‘দেশজুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ চলছে। অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ব্যুমেরাং হয়ে গিয়েছে। এবার কয়েকমাসের মধ্যে এনপিআর শুরুর চিন্তাভাবনা চলছে। তবে অর্থনীতিতে ধস, উন্নয়নের ভাঁটা বা শিল্পে মন্দা নিয়ে কোনও আলোচনা নেই। দেশের মূল সমস্য়াগুলো থেকে সকলের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর বিরুদ্ধে মিলিতভাবে লড়াই করতে হবে।’

যদিও, বিজেপির মুখে এই বৈঠক নিয়ে কটাক্ষের সুর শোনা গিয়েছে। এদিকে একাধিক দলের অনুপস্থিতিতে বিরোধী শিবিরের ছবিটা যেমন ছন্নছাড়া, তেমন শাসক শিবিরের ছবিও খুব একটা স্বস্তিকর নয়। কারণ, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, এনডিএ-র শরিক, নীতীশ কুমার এদিন বিধানসভায় দাঁড়িয়ে এনআরসির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। সব মিলিয়ে সংশোধিত নাগরিরকত্ব আইন নিয়ে টানাপোড়েনের পারদ তুঙ্গে।