কলকাতা: তাঁর ক্যামেরা যে গল্প বলত, তাতে মিলেমিশে যেত কলকাতার গলিঘুঁজি। গল্প যত এগোত, দর্শক আর দর্শক থাকতেন না, হয়ে উঠতেন সিনেমার অংশ। সেই সব ছবি সুখী জীবনের কথা বলত না। থাকত না হ্যাপি এন্ডিং। বরং রয়ে যেত অসংখ্য না মেটা প্রত্যাশা আর অনন্ত জিজ্ঞাসার কিছু মুহূর্ত। এই সব কিছু নিয়েই ছিলেন মৃণাল সেন। আজ সকাল ১০টা ৩৫ মিনিট নাগাদ চলে গিয়েছেন তিনিও।


বছরশেষের এই ডিসেম্বরের শীত এবার রাজ্যবাসীকে এনে দিল একের পর এক যন্ত্রণার সমাহার। প্রথমে গায়ক দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তারপর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও এখন মৃণাল সেন। ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়রা তো কবেই চলে গিয়েছেন। গিয়েছেন তপন সিংহও। কলকাতার সম্পদ বলতে ছিলেন শুধু মৃণাল সেন। রবিবারের সকালে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডার মধ্যে শেষ পাড়ি জমালেন ভুবন সোম-এর স্রষ্টা।

৬৫ বছরের বিবাহিত জীবনে ইতি টেনে গত বছর জানুয়ারিতে চলে যান স্ত্রী গীতা সেন। ছেলে কুণাল থাকেন আমেরিকায়, ভবানীপুরের বাড়িতে একাই থাকতেন বিশ্বখ্যাত চিত্র পরিচালক। দীর্ঘদিন ভুগছিলেন অসুস্থতায়। ৯৫ বছর বয়সে শেষ হল তাঁর যাত্রা।

জন্ম ১৯২৩ সালের ১৪ মে, বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরে৷ সেখানেই কাটিয়েছেন প্রথম ১৭টা বছর৷ বাবা দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন নামকরা আইনজীবী৷ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল৷ স্কুলে পড়ার সময় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ব্রিটিশ পুলিশের সামনে বন্দেমাতরম গেয়ে গ্রেফতারও হন মৃণাল সেন৷

প্রথম ছবি রাত-ভোর। সেটা ১৯৫৫। উত্তম কুমার তখনও উত্তম কুমার হননি, ছবিতে ছিলেন তিনি। ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস, জহর রায়। চলেনি ছবিটি। দ্বিতীয় ছবি নীল আকাশের নীচে (১৯৫৯)। কলকাতায় ভালই চলে, পরিচিতি পান মৃণাল। আর তৃতীয় ছবি বাইশে শ্রাবণ তাঁকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক পরিচিতি। কিন্তু ভারতীয় চলচ্চিত্র দুনিয়া আভূমি বদলে দিল তাঁর ভুবন সোম। গুজরাতের রুক্ষ গ্রামাঞ্চলের পটভূমিতে এক মধ্যবয়স্ক সরকারি চাকুরে ও গ্রাম্য তরুণীর সম্পর্ক এবং পাখি শিকার করতে করতেই চরিত্রের উত্তোরণের এই ছবি নিউ সিনেমা আন্দোলনের সূচনা করে। ভুবন সোম তাঁকে এনে দেয় সেরা ছবি ও সেরা পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার।

সেই শুরু। এরপর থেকে সমার্থক হয়ে ওঠে মৃণাল সেন ও পুরস্কার। পুনশ্চ, আকাশ কুসুম, ওড়িয়া ছবি মাটিরা মনিষা, কলকাতা ৭১, পদাতিক,  কোরাস,  মৃগয়া, ওকা উরি কথা, পরশুরাম,  একদিন প্রতিদিন, আকালের সন্ধানে... তালিকাটা বিরাট লম্বা৷ মোট ১৬টি ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনি৷ ১৯৭৫-এ তাঁর ছবি কোরাস মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় পুরস্কার পায়। ১৯৭৯-তেও পরশুরাম ছবিটি রূপো জেতে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন কার্লোভি ভ্যারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ও কার্থেজ চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার জেতে তাঁর তেলুগু ছবি ওকা উরি কথা।

কমিউনিস্ট ছিলেন। ভুবন সোম পরবর্তী সময়ে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাও বারবার ছায়া ফেলেছে ছবিতে। এসেছে নানা ধরনের আইডিয়া- এক্সটেনশিয়ালিজম, সুররিয়ালিজম, জার্মান এক্সপ্রেশনিজম, পোস্ট মডার্নিজম ইত্যাদি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা হয়ে পড়েন। কিন্তু ভাবনাচিন্তায় আজন্ম ছিলেন অন্যপথের যাত্রী। চেয়েছিলেন, শেষ যাত্রায় যেন আড়ম্বর না হয়, তা জানিয়েও গিয়েছেন নিজের ঘনিষ্ঠজনদের। তাঁর ছেলে আমেরিকা থেকে ফিরলে শেষকৃত্য হবে।