সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা: শিব পুরাণ অনুসারে একবার পার্বতী শিবের গণ অর্থাৎ অনুচর নন্দীকে দ্বার রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে বলেন, ‘কেউ যেন মহলের ভিতর যেতে না পারে’। এমন সময় শিব সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। এতে ধর্ম সংকটে পড়লেন নন্দী। একদিকে শিব তাঁর প্রভু, অন্য দিকে পার্বতীর আদেশ। কিন্তু নন্দী প্রভুকে বাধা দিলেন না। এদিকে শিবকে ভেতরে দেখে ক্রুদ্ধ হলেন পার্বতী। তখনই সখীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন এমন এক অনুচর তৈরি করতে হবে যে সব সময় পার্বতীর কথা শুনে চলবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পার্বতী নিজে যে চন্দন এবং হলুদ মেখে রূপচর্চা করতেন, শরীর থেকে সেই চন্দন এবং হলুদ নিয়ে এক বালকের মূর্তি গড়ে তুললেন। এরপর সেই বালকের মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকেই দ্বার রক্ষার দায়িত্ব দিলেন পার্বতী। কিছুক্ষনের মধ্যেই শিব এসে উপস্থিত হলেন সেখানে। তিনি ভেতরে যাবেন। এদিকে মায়ের অনুমতি ছাড়া তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না বালক। কথা কাটাকাটি হতে হতে বালকটি তার হাতের দণ্ড দিয়ে শিবকে আঘাত করে বসল।


অপমানিত শিব নিজের বাড়িতে ঢুকতে না পেরে ফিরে গেলেন। আর তাঁর অনুচরদের বলে গেলেন এই বালককে উচিত শিক্ষা দিতে। এবার শিবের অনুচররা আক্রমণ করল। তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ হল বালকের। তাঁরাও বালকের হাতে যথেষ্ট ঘায়েল হয়ে পালিয়ে গেল। সেই সংবাদ যখনই শিবের কাছে পৌঁছল তখনই অন্দরমহলেও পৌঁছল পার্বতীর কাছে। শিবের ফিরে যাবার কথা শুনে কিছুটা দ্বিধায় পড়লেও পুত্রকে দ্বার আগলে রাখারই নির্দেশ পাঠালেন পার্বতী। এবার ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং ইন্দ্র এক সঙ্গে শিবের কাছে হাজির হলেন। সবাই মিলে পরামর্শ করার পর ঠিক হল ব্রহ্মা ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে একদল সন্ন্যাসীকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তাঁরা যখন পার্বতীর প্রাসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তাঁদেরও আক্রমণ করল বালক। তাঁরা প্রাণভয় সেখান থেকে পালালেন।


এবার শিব তাঁর পুত্র দেবসেনাপতি কার্তিককে ডাকলেন। কার্তিকের সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতারা সমস্ত দিক থেকে বালকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বালকটি লড়াই চালিয়ে গেল। এদিকে দেবতাদের আক্রমণের খবর পেয়ে পার্বতী খুবই ক্ষুব্ধ হলেন এবং তাঁর দুই শক্তি কালী এবং দুর্গাকে পাঠালেন বালককে রক্ষা করতে। একে একে দেবতারা পরাস্ত হতে লাগলেন। শিব এই বালকের লড়াই দেখে বুঝলেন কৌশল ছাড়া একে বধ করা সম্ভব নয়। বিষ্ণুও তা বুঝতে পেরে মায়ার আশ্রয় নিলেন। একদিক থেকে শিব, অন্য দিক থেকে বিষ্ণু আক্রমণ করতে লাগলেন। বালকটিও অসীম সাহসের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে গেল। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন শিব এবং বিষ্ণু দুজনেই। পিছন থেকে ত্রিশূল দিয়ে বালকের মাথা কেটে দিলেন শিব। দেবতারা আনন্দে মেতে উঠলেন। কিন্তু চিন্তায় পড়়ে গেলেন শিব। কি করে তিনি মুখ দেখাবেন পার্বতীর কাছে, এটাই ভাবতে লাগলেন। এদিকে পুত্রের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পার্বতী সহস্র শক্তি সৃষ্টি করে দেবতাদের ধ্বংসের নির্দেশ দিলেন।


ভয়ঙ্কর লড়াই শুরু হল। যখন দেবকুল ধ্বংস হতে বসেছে, তখন ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু পার্বতীর শরণাপন্ন হলেন। পার্বতী পুত্রের জীবন এবং সম্মান ফিরিয়ে দিতে বললেন তাঁদের। এই খবর যখন শিবের কাছে পৌঁছোল, তিনি নির্দেশ দিলেন উত্তর দিকে গিয়ে প্রথম যে প্রাণী দেখতে পাওয়া যাবে তার মাথাটি কেটে এই বালকের শরীরে জুড়ে দিলেই সে জীবন্ত হয়ে উঠবে। তেমনটাই করলেন দেবতারা। উত্তর দিকে গিয়ে প্রথমে একটি ছোট হাতি দেখে তার মাথাটাই কেটে এনে বালকের শরীরে জুড়ে দিতেই প্রাণ ফিরে পেল সে।


হাতির মাথা সমেত পুত্রকে দেখে কেঁদেই আকুল পার্বতী। এই সন্তানকেকে সম্মান করবে? এই প্রশ্ন তাঁর মনে উঠে এল। এরইমধ্যে সব দেবতারা মিলে শিবকে নিয়ে এলেন পার্বতী কাছে। শিব পার্বতীর কাছে মাথা নোয়ালেন। বুঝলেন তাঁর মাথা গরম থেকেই এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে। এবার শিব বালককে আশীর্বাদ করে তাঁকে তাঁর অনুচর অর্থাৎ গণের অধিনায়ক পদে বরণ করলেন। তার থেকেই বালকের নাম হল গণেশ। একইসঙ্গে আশীর্বাদ করে বললেন, এবার থেকে যে কোনও দেবতার আগে গণেশের পুজো হবে। তাঁর পুজোর পরই সমস্ত কাজ শুরু হবে। তাই তিনি হবেন বিঘ্ননাশক।