বেঙ্গালুরু: পূর্ব পরিকল্পনামাফিকই গোটা প্রক্রিয়া এগিয়েছে। শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন স্পেস সেন্টার থেকে চন্দ্রাভিমুখী অভিযানে রওনা, পৃথিবীর কক্ষপথ বদল করে চাঁদের কক্ষপথে ঢুকে পড়া, অরবিটার থেকে ল্যান্ডার ‘বিক্রমের’ গতি কমিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের অন্তিম প্রহর পর্যন্ত সবটা ঠিকই ছিল। বিপত্তি ঘটে চাঁদের মাটি থেকে মাত্র ২.১ কিলোমিটার দূরত্বে। গভীর রাতে হঠাৎ ইসরো-র সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায় ল্যান্ডার বিক্রমের। কোথায় আছে বিক্রম, কীভাবেই বা আছে, আদৌ চাঁদের মাটি ছুঁল কিনা, নাকি ধ্বংস হয়ে গেল, রোভার ‘প্রজ্ঞান’-ই বা কী অবস্থায়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এই সব প্রশ্নের উত্তরই হাতড়ে বেড়াচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তাহলে কি এবারও ‘অসফল’ তকমা জুটবে ‘মুনমিশন’-এ। না, পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত যাওয়ার এই জটিল পক্রিয়া ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই সফল। প্রত্যাশিত সাফল্য এখনও হাতের নাগালে না আসলেও কে শিবনরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ল্যান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার। ইসরো বিজ্ঞানীদের এই প্রচেষ্টাই নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে। স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, “প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে তথ্যানুসন্ধানে যে উন্মাদনা বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, তাতে আমরা গর্বিত। গোটা দেশ ইসরোর পাশে।” সফট ল্যান্ডিং পরিকল্পনামাফিক না হওয়ায় বাধা তৈরি হলেও চন্দ্রাভিযান ‘নতুন ভোরের সন্ধান দিয়েছে, যা খুব শীঘ্রই আরও উজ্জ্বল দিন নিয়ে আসবে’, বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে মন্তব্য নরেন্দ্র মোদির।
এখানেই শেষ নয়। শনিবার যখন বেঙ্গালুরুতে ইসরোর সদর দফতর থেকে বেড়িয়ে আসছেন নরেন্দ্র মোদি, তখন দেখা যায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়া, ক্রন্দনরত ইসরো চেয়ারম্যান কে শিবনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদির কাঁধে মাথা রেখে যেন ‘সন্তান’ হারানোর বেদনায় আকুল কে শিবন। পিঠে হাত বুলিয়ে শিবনকে স্বান্তনা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হতেই গোটা বিশ্বে তা ভাইরাল হয়ে যায়। রকেট স্পিডে তা ছড়িয়ে যায় ট্যুইটার, ফেসবুক সহ একাধিক সোশ্যাল মাধ্যমে।
হৃদয় উদ্বেল করে দেওয়া এই মুহূর্ত ইসরোর বিজ্ঞানীদের মনোবল বাড়িয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান তো বটেই, প্রাক্তন ইসরো চেয়ারম্যান কে কস্তুরিরঙ্গন, এ এস কিরণ কুমারও মোদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাঁদের প্রত্যেকেরই একই বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদি যেভাবে বিজ্ঞানীদের মনোবল বাড়িয়েছেন তাতে তাঁরা প্রত্যেকেই খুশি। প্রধানমন্ত্রীর আলিঙ্গন মন ছুঁয়ে গেছে কে শিবনের।
পিটিআইকে কে কস্তুরিরঙ্গন জানিয়েছেন, “প্রধানমন্ত্রী অবিশ্বাস্যকর ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তাঁর আবেগঘন এবং অর্থবহ এই বার্তার চেয়ে আর ভাল কিছুই হত না।” এ এস কিরণ কুমার বলেন, “আমরা দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।”
প্রসঙ্গত, শনিবার রাতের হতাশার মধ্যেই রবিবার ইসরোর তরফে জানানো হয় ল্যান্ডার বিক্রমের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। এখনও যোগাযোগ সম্ভব না হলেও ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়, অরবিটার ল্যান্ডার বিক্রমের ছবি পাঠিয়েছে। আগামী ১৪ দিন ল্যান্ডার বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের যাবতীয় চেষ্টাই বিজ্ঞানীরা করবেন। তবে এটাও ঠিক, সময় যত এগোচ্ছে ততই কঠিন হচ্ছে গোটা প্রক্রিয়া।
চেষ্টা চালালেও সময় যত বইবে ল্যান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ততই কঠিন হবে বলে জানিয়েছেন গবেষণা কেন্দ্রেরই এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক। তাঁর মতে, পরিকল্পনা থাকলেও পালকের মতো চাঁদের মাটিকে নামানো যায়নি ল্যান্ডার বিক্রম-কে। সম্ভবত ‘হার্ড ল্যান্ডিংয়ের’ কারণেই আঘাত পেয়েছে ল্যান্ডার। চার পায়ে নামার কথা ছিল এই বিশেষ মহাকাশ যন্ত্রের, সেটা হয়নি। আর সেটা না হওয়াতেই হয়ত চাঁদের মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিক্রম। তিনি জানান, এই ল্যান্ডারটি নকশা প্রস্তুত করা হয়েছিল সফট ল্যান্ডিংয়ের কথা ভেবেই। ১ হাজার ৪১৭ কেজির ল্যান্ডার, যার মধ্যে ২৭ কেজি রোভার প্রজ্ঞানের ওজন। এই ল্যান্ডারের নামকরণ করা হয়েছে বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের নামে। আর ৬ চাকাওয়ালা রোভার 'প্রজ্ঞান' সংস্কৃত শব্দের বাহক। ধীশক্তি, আত্মজ্ঞান, বিজ্ঞতাকে মাথায় রেখেই রোভারের নামকরণ হয়েছে।