কলকাতা: সংসদীয় রাজনীতিতে যে কোনও সঙ্কট সামলে দেওয়ার দক্ষতা ছিল তাঁর! ভারতীয় রাজনীতির অলিন্দে পরিচিত ছিলেন ট্রাবলশ্যুটার বা ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসেবে। ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি চাণক্য। যে কোনও কঠিন পরিস্থিতি তিনি সামলে দিয়েছেন কূটনৈতিক বুদ্ধির জোরে। যে কোনও কঠিন যুদ্ধেই জয় অনিবার্য করেই ফিরতেন তিনি। তবে এবারের সঙ্কটটা আর কাটিয়ে উঠতে পারলেন না!


সাল ২০২০। আবারও নক্ষত্রপতন। রত্নহারা হল ভারত। চলে গেলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। ভারতরত্ন প্রণব মুখোপাধ্যায়। সোমবার দিল্লির সেনা হাসপাতালে মৃত্যু হল তাঁর।

নিজের করোনা আক্রান্তের খারাপ খবরটা নিজেই ট্যুইট করে জানিয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। লিখেছিলেন, 'অন্য চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলাম। করোনা-পরীক্ষায় রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। গত এক সপ্তাহে যাঁরা আমার সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাঁদের অনুরোধ করছি, সেলফ আইসোলেশনে থাকুন এবং করোনা পরীক্ষা করিয়ে নিন।'

এই লড়াইটা জেতা হল না প্রণবের।  চলে গেলেন ভারতীয় রাজনীতির এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিক প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পাশাপাশি মানুষ মনে রাখবে ব্যক্তি প্রণবকেও, যাঁর জীবনজুড়ে নানা গল্পের আনাগোনা। সেই পাতাগুলিতেই একটু চোখ বোলানো যাক।

  • বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। দেশকে স্বাধীন করতে জেলও খাটেন। অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন তাঁর বাবা। মা রাজলক্ষ্মীদেবীই ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বেশি কাছের। আদর করে মা তাঁকে ডাকতেন পল্টু বলে!


 

  • কীর্ণাহার শিবচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কুল জীবনের পাঠ শুরু হয়েছিল তাঁর। এরপর সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক। এরপর ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। ১৯৬৩ সালে আইন পাস। পড়াশোনা শেষ করেই কর্মজীবনে প্রবেশ। প্রথম জীবনে, ১৯৬৩ সালে কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। প্রায় ২ বছর অধ্যাপনা করা ছাড়াও, 'দেশের ডাক' নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।


 

  • একসময় ধূমপান করতেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তবে সিগারেট নয়, তাঁর পছন্দ ছিল পাইপ। কালো রঙের ডানহিলের পাইপ ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক। এমনকি সংসদে ধূমপায়ী সাংসদদের নিয়ে ‘স্মোকার্স ক্লাব’-ও তৈরি করেছিলেন তিনি। পরে অবশ্য সংসদে ধূমপান নিষিদ্ধ হয়ে যায়। চিকিত্‍সকদের পরামর্শে ধূমপান ছেড়ে দেন প্রণবও।


 

  • বরাবর খাদ্যরসিক ছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। ছোট থেকেই মাঝের ঝোল আর ভাত ছিল তাঁর প্রিয়। খেতে তিনি কতটা ভালবাসতেন, তা নিয়ে একবার বলেছিলেন, ‘যখন আমি ছোট ছিলাম, সকালের জলখাবার শেষ করেই মা-কে জিজ্ঞাসা করতাম দুপুরে কী রান্না করেছ? আবার দুপুরে খাওয়ারের সময় জেনে নিতাম রাতের খাবারে কী হয়েছে!’


 

  • প্রতিবছর মিরিটি গ্রামে নিজের বাড়ির দুর্গাপুজোয় আসতেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এমনকী, রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। পুজোয় সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকতেন। নিজে চণ্ডীপাঠ করতেন।


 

  • ২০১৩ সালের মার্চ মাসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম বিদেশসফরে বাংলাদেশে যান প্রণব মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশের নড়াইলে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। সেবার বাংলাদেশ সরকারের আতিথেয়তায় মুগ্ধ প্রণবের মুখে শোনা যায় অজানা অনেক কাহিনি।


 

  • প্রথম জীবনে, ১৯৬৩ সালে কলেজে অধ্যাপনা করতেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এরপর ২০১৬। রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেয়াদ ফুরনোর ঠিক এক বছর আগের শিক্ষকদিবসের অনুষ্ঠানে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ফের পাওয়া যায় শিক্ষকের ভূমিকায়। দিল্লির রাজেন্দ্রপ্রসাদ সর্বোদয় বিদ্যালয়ে ক্লাস নেন তিনি। বিষয় ছিল, ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাস ও বিবর্তন।


 

  • শোনা যায়, প্রণব মুখোপাধ্যায় চিনা রাজনীতিক ডেং জিয়াওপিং দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর উদ্ধৃতির উল্লেখ করতেন।


 

  • প্রতিদিন প্রায় ১৮ ঘণ্টা কাজ করতেন তিনি। রাত জেগে কাজ করতে ভালবাসতেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি।


 

  • কর্মযোগী মানুষটি স্বাস্থ্যসচেতন বরাবর। একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, আমি প্রতিদিন লনে ৪০ রাউন্ড হাঁটি। হিসেব করলে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার।


 

  • গত ৪০ বছর ধরে ডায়েরি লেখার অভ্যাস তাঁর। সারা দিনের নানা অভিজ্ঞতা নথিবদ্ধ রাখতেন তিনি।


 

  • উদার অর্থনীতির যুগের আগে ও পরেও তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান। এই রেকর্ড অন্য কারও নেই।