কলকাতা: দারিদ্র দূরীকরণ নিয়ে কত কথাই তো শোনা যায়। প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু দারিদ্রকে না বুঝলে কী করে দারিদ্রকে দূর করবেন? প্রশ্নকর্তা আর কেউ নন, তিনি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী বাঙালি।


১৯৬১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুম্বইয়ে জন্ম অভিজিতের। বাড়ি দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জে। বাবা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান। মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায় সেন্টার ফর স্টাডিস ইন সোশাল সায়েন্সেস-এর শিক্ষক ছিলেন।

মা-বাবা দু’জনেই অর্থনীতিবিদ, এমন আবহে বেড়ে ওঠা অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তবে অনেকের মতো জয়েন্ট কিম্বা আইআইটি এন্ট্রান্সের পথে হাঁটেননি তিনি। সাতের দশকের শেষদিকে সাউথ পয়েন্টের পড়া শেষ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক হন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই শুরু স্বপ্নের উড়ানের। আর এবার কলকাতার সেই ছেলেই বিশ্বসেরা। এবিপি আনন্দকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যিনি সোমবার জানিয়েছেন, ২৩ অক্টোবর তিনি কলকাতায় আসবেন।

১৯৮১-তে অভিজিৎ স্নাতকোত্তর পড়তে যান দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৩-তে JNU-এর পর্ব চুকিয়ে তিনি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যান। তাঁর গবেষণাপত্রের নাম ছিল - এসে ইন ইনফরমেশন ইকনমিকস।

২০০৩-এ অর্থনীতিবিদ এস্থার ডাফলো আর সেনধিল মুল্লাইনাথনকে নিয়ে আবদুল লতিফ জামিল পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব (J-PAL) তৈরি করেন অভিজিৎ। নিজে সামলালেন ডিরেক্টরের দায়িত্ব। ২০০৪ সালে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেসে ফেলো নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৯-এ অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণার জন্য ইনফোসিস পুরস্কার পান অভিজিৎ। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের ডেভলপমেন্ট অ্যাজেন্ডা কর্মসূচি সংক্রান্ত কমিটিতে ছিলেন তিনি। পরের বছরই অর্থনীতিতে বার্নহার্ড-হার্মস পুরস্কারে সম্মানিত হন অভিজিৎ। এই মুহূর্তে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক অধ্যাপক হিসেবে এমআইটি-তে কর্মরত তিনি।

অভিজিৎ রাষ্ট্রপুঞ্জেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন। ২০১৫ পরবর্তী ডেভলপমেন্ট অ্যাজেন্ডা কর্মসূচিতে রাষ্ট্রপুঞ্জের সচিবের বিশিষ্ট প্রতিনিধি প্যনেলে ছিলেন তিনি। অর্থনীতির ওপর বিনায়কের লেখা চারটি বই বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এরমধ্যে ‘পুওর ইকোনোমি’ বইটি গোল্ডম্যান স্যাকস বিজনেস বুক সম্মানে ভূষিত হয়।

এস্থার ডাফলো

অন্য নোবেল প্রাপক অভিজিতের স্ত্রী এস্থারের জন্ম ১৯৭২ সালে প্যারিসে। তিনিও এমআইটি থেকে গবেষণা করছেন। ইতিহাসবিদ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পথ তৈরি হয় অর্থনীতিতেই। বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য, শিশুমৃত্যু, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অবনতি তাঁকে মুচড়ে দিত, টানতও একই সঙ্গে। ইতিহাস ও অর্থনীতি, দুই নিয়েই শুরু হয় এস্থার ডাফলোর জার্নি। হাত ধরেন অধ্যাপক-গবেষক, সহকর্মী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ্বে দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে স্বামী অভিজিতের সঙ্গে নোবেল পেয়েছেন তিনিও। এস্থারই অর্থনীতিতে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেল প্রাপক। অর্থনীতিতে একই সঙ্গে একই বছর স্বামী-স্ত্রী যুগ্মভাবে নোবেল প্রাপ্তি এই প্রথম। ১৯০৩ সালে পদার্থবিদ্যায় তেজস্ক্রিয়তার উপর গবেষণায় স্বামী পিয়ের কুরির সঙ্গে নোবেল পেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী মেরি কুরি।

মাইক্রো-ইকনমিক্স নিয়েই মূলত গবেষণা এস্থারের। উন্নয়নশীল দেশগুলির আর্থ-সামাজিক অবস্থাও তাঁর গবেষণাপত্রের অন্যতম বিষয়। যার মধ্যে রয়েছে গার্হস্থ্য সমস্যা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থা, স্বাস্থ্য-সহ অনেক কিছু।

১৯৭২ সালে প্যারিসে জন্ম এস্থারের। বাবা মাইকেল ডাফলো অঙ্কের অধ্যাপক। মা ডাক্তার। ছোট থেকেই ইতিহাসের নানা বিষয় টানত এস্থারকে। জানিয়েছেন, যখন বয়স আট বছর, চেয়েছিলেন ইতিহাসবিদ হবেন। ইউনিভার্সিটিতে তাঁর বিষয়ও ছিল ইতিহাস। ১৯৯৩ সালে মস্কোতে দশ মাস থেকে তিনি অধ্যাপনা করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস, রাজনীতি নিয়ে চর্চা শুরু হয়। একই সঙ্গে তাঁর আকর্ষণের বিষয় হয়ে ওঠে অর্থনীতি। ইউনিভার্সিটি থেকে একই সঙ্গে ইতিহাস ও অর্থনীতি নিয়ে ডিগ্রি লাভ করেন এস্থার।

১৯৯৯ সালে ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি থেকে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা শেষ করেন। রিসার্চ স্কলার থাকার সময়েই তাঁর পছন্দের অধ্যাপক ছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জোসুয়া অ্যাঙ্গরিস্ট। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানেই বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এস্থার। এমআইটিতেই অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

২০০৩ সালে এমআইটিতেই 'পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব' তৈরি করেন। স্যর, বন্ধু, সহকর্মী অভিজিতের সঙ্গে এই ল্যাবেই অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে অন্তত ২০০টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এস্থার। ২০১০ সালে কম বয়সে অর্থনীতিতে অন্যরকম ভাবনা ও পথপ্রদর্শনের জন্য ‘জন বেটস ক্লার্ক মেডেল’ পান এস্থার। ওই বছরেই ইউনিভার্সিটি অব ক্যাথলিক দে লাওভেন থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়ে যান এস্থার। সমাজ বিজ্ঞান এবং অর্থনীতিতে ইনফোসিস পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে ওঠে ২০১৪ সালে।

২০১১ সালে টাইম ম্যাগাজিন-এর প্রকাশিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় প্রথম সারিতেই দেখা যায় এস্থার ডাফলোর নাম। তাঁর লেখা প্রথম বই ২০০৬ সালে। ২০১১ সালে স্বামী অভিজিতের সঙ্গে লিখেছিলেন  'পুওর ইকনমিক্স: রিথিঙ্কিং পভার্টি অ্যান্ড দ্য ওয়েস টু এন্ড ইট'। ২০১২ সালে এই বইয়ের জন্য স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই 'জেরাল্ড লোয়ের অ্যাওয়ার্ড' দেওয়া হয়।

মাইকেল রবার্ট ক্রেমার

মার্কিন অর্থনীতিবিদ মাইকেল বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপিং সোসাইটি বিভাগের গেটস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। সাফল্যের জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস-এর একজন ফেলো। ১৯৯৭ সালে ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ এর একজন অভ্যর্থনাকারীও ছিলেন। এছাড়াও তিনি ইনোভেশন ফর পোভার্টি অ্যাকশন এর একজন গবেষক।

 

ক্রেমার ওয়ার্ল্ডটিচ এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট, যেটি হার্ভার্ড ভিত্তিক একটি সংস্থা যেখানে কলেজ ও সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীবৃন্দ স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে বিশ্বের উন্নত দেশের জন্য সারাবছর বিভিন্ন প্রোগ্রাম পরিচালনা করে থাকে। তিনি "ক্রেমার্স ও-রিং থিওরি অব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট" নামে একটি তত্ত্ব তৈরি করেছেন। ক্রেমার ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক গ্রোথ সেন্টারে তিনি ফিল্ড অব হিউম্যান ক্যাপিটাল নামে গবেষণা প্রবন্ধ লেখেন। ক্রেমার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিক বিজ্ঞানে স্নাতক। ১৯৯২ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এমআইটিতে পোস্টডক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত এমআইটিতে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।