কলকাতা: শ্রীরামপুর স্টেশন সংলগ্ন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র অ্যাভিনিউয়ে পিচরাস্তার ধারে ফুটপাতে খাটানো রঙিন ছাতা। তার নীচে কাঠের চৌকির ওপর বেছানো সবুজ প্লাস্টিকে থরে থরে সাজানো পসরা। মাস্ক, গ্লাভস, পোশাক। ছাতার নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝবয়সী হাসছেন। মুখ মাস্কে ঢাকা। তাও স্বস্তিমাখা চোখ দিয়ে যেন চুঁইয়ে পড়ছে গর্ব, স্বপ্ন, প্রত্যয়।

শ্রীরামপুর স্টেশন চত্বরের দীর্ঘদিনের হকার গোবিন্দ সাহার একমাত্র সন্তান ঋতম যে অভাবের সংসারে আলো জ্বেলে দিয়েছে! উচ্চমাধ্যমিকে ৫০০-র মধ্যে পেয়েছে ৪৭৯। ৯৬ শতাংশ নম্বর পেয়েছে উত্তরপাড়া অমরেন্দ্র বিদ্যাপীঠের কৃতী ছাত্র। ঋতমের প্রাপ্ত নম্বর? বাংলায় ৮৫, ইংরেজিতে ৮৪, অঙ্কে ৯৯, স্ট্যাটিস্টিক্সে ৯৯, কেমিস্ট্রিতে ৯৯ ও ফিজিক্সে ৯৭।

ছেলের উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বসিত গোবিন্দ। দোকানের খরিদ্দারদের মাল বিক্রি করার ফাঁকেই বললেন, ‘আমি নিজে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তে পড়তে বাবার হাত ধরে শ্রীরামপুরের এই জায়গায় হকার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করি। প্রথমে হাতা-খুন্তির মতো হেঁশেলের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বিক্রি করতাম। পোশাকের ব্যবসা শুরু করেছি তা-ও প্রায় ২০ বছর হয়ে গেল। উচ্চমাধ্যমিকে ভাল ফল করেছে ঋতম। আমার অপূর্ণ স্বপ্নগুলো ও পূরণ করুক, সেই প্রার্থনাই করি।’

বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, পুত্রকে নিয়ে অভাবের সংসার গোবিন্দর। রিষড়া বালক সংঘের কাছে এক চিলতে বাড়ি। এক কামরার মধ্যেই কার্যত মাথা গোঁজা সকলের। ঋতম মাধ্যমিক পাশ করে শ্রীরামপুর ইউনিয়ন স্কুল থেকে। তবে ইচ্ছে থাকলেও সেই স্কুলে একাদশে ভর্তি হয়নি। কেন? এবিপি আনন্দকে ঋতম বলল, ‘আমার স্বপ্ন ছিল স্ট্যাটিস্টিক্স নিয়ে পড়াশোনা করার। ইউনিয়ন স্কুলে একাদশ-দ্বাদশে বিষয়টা নেই। তাই উত্তরপাড়া অমরেন্দ্র বিদ্যাপীঠে ভর্তি হওয়া।’

স্ট্যাটিস্টিক্স নিয়েই উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ঋতমের। ভবিষ্যতে হতে চায় পরিসংখ্যানবিদ। কিন্তু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হতে চেয়ে পরিসংখ্যানবিদ হওয়ার ইচ্ছে কেন? ‘আমার প্রিয় বিষয় স্ট্যাটিস্টিক্স। খেলাধুলো থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিসংখ্যানবিদের কাজের পরিধিটা বিশাল বড়। এ নিয়ে খুব আগ্রহ রয়েছে আমার। ডেটা অ্যানালিসিস করতে ভাল লাগে। তাই ভবিষ্যতে পরিসংখ্যানবিদ হতে চাই। স্ট্যাটিস্টিস্কে অনার্স নিয়ে বিএসসি করব। তারপর ওই বিষয়েই এমএসসিও করতে চাই। ইচ্ছে আছে এমবিএ করারও,’ বলছিল ঋতম।

সময় পেলে শ্রীরামপুরের আরএমএস মাঠের উল্টোদিকের ফুটপাতে বাবার ব্যবসা সামলায় ঋতম। তার কথায়, ‘স্কুলের পর শ্রীরামপুরেই দুজন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তাম। পড়া মিটিয়ে অনেক সময় বাবাকে সাহায্য করতাম ব্যবসায়।’ বাবার সংগ্রাম ঋতমের সংকল্পকে আরও দৃঢ় করেছে। বলছে, ‘ছোট থেকেই দেখছি বাবা অসম্ভব পরিশ্রম করেন। আমার পড়াশোনার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। ভবিষ্যতে সফল হয়ে সংসারের হাল ফেরাতে চাই।’

শৈশবে পড়েছে রিষড়ারই এক স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণি থেকে শ্রীরামপুরের ইউনিয়ন ইনস্টিটিউটে। মাধ্যমিকেও চমকপ্রদ রেজাল্ট হয়েছিল। ঋতম অঙ্কে পেয়েছিল একশোয় একশো। উচ্চমাধ্যমিকের প্রস্তুতি কীভাবে সারতে? ঋতম বলছে, ‘রাত জেগে পড়াশোনা করতাম। সকালটা স্কুলে কাটত। ফিরতে পাঁচটা বেজে যেত। স্কুলে রোজ যাওয়াটা বাধ্যতামূলক ছিল। তা না হলেই অভিভাবকদের ডেকে পাঠানো হতো। স্কুলের পর সপ্তাহে চারদিন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে যেতাম। ফিরতে রাত ৮টা বাজত। তাই রাতেই পড়তাম। তিনটে-সাড়ে তিনটে পর্যন্ত। তবে ছুটির দিন সকালেও পড়েছি।’

পড়াশোনার বাইরে ক্রিকেট খেলতে ভালবাসে ঋতম। প্রিয় ক্রিকেটার? ‘বিরাট কোহলি,’ নিমেষে বলে দিচ্ছে সে। যোগ করছে, ‘তবে আইপিএলে সমর্থন করি কলকাতা নাইট রাইডার্সকেই।’ অবসর সময়ে আর কী করো? ঋতম বলছে, ‘মোবাইলে ইউটিউব খুলে মোটিভেশনাল স্পিকার সন্দীপ মাহেশ্বরী, বিবেক বিন্দ্রার বক্তৃতা শুনি। খুব উৎসাহ পাই। সিনেমাও দেখি।’ স্নাতক স্তরে ভর্তি কোথায় হবে? ঋতমের কথায়, ‘প্রথম ইচ্ছা প্রেসিডেন্সি। ফর্ম ফিল আপ করেছি। করোনার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষার দিন ঘোষণা হয়নি এখনও। পাশাপাশি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ কলেজ ও মৌলানা আজাদ কলেজেও চেষ্টা করব। কারণ এই জায়গাগুলোতে স্ট্যাটিস্টিক্স বিভাগ বেশ ভাল।’

দারিদ্র্যকে হারিয়ে আপাতত পরিসংখ্যানবিদ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর রিষড়ার মেধাবী।