সঞ্চয়ন মিত্র ও সুনীত হালদার, হাওড়া: এখনও সে নিজে থেকেই গোটা একটা জঙ্গল। শরীর এখনও শক্তপোক্ত। তার ডালে ডালে যুগ যুগ ধরে বাসা বেঁধেছে কত পাখি। কিন্তু আড়াইশো বছরে আর উমপুনের দাপট সামলাতে পারেনি সে, সমানে যুঝলেও ক্ষতবিক্ষত হয়েছে শরীর। তবু এখনও দাঁড়িয়ে বোটানিক গার্ডেনের বৃদ্ধ বটগাছ। পরশুর ঝড়ে তার অনেক সঙ্গীর শেকড় উপড়েছে কিন্তু লড়াই ছাড়েনি সে।


‘দ্য গ্রেট ব্যানিয়ান ট্রি’। নাম আছে গিনেস বুকে। যার জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি শিবপুরের জগদীশচন্দ্র বোস ইন্ডিয়ান বোটানিক গার্ডেনের। কিন্তু উমপুন ছেড়ে কথা বলেনি বিশ্বের অন্যতম বিশাল এই বট গাছকেও। সুপার সাইক্লোন আঘাত হেনেছে তার মূলে। বৃদ্ধ বট আর আগের মতো যুঝতে পারেনি!

গার্ডেনের আধিকারিক ও বিজ্ঞানীদের অনুমান, এই গাছের জন্ম ১৭৭০ সাল নাগাদ। সেই হিসেবে বয়স প্রায় ২৫০ বছর। ১৭৩৭-এর ভয়াবহ সাইক্লোন না দেখলেও ১৮৬৪ সালের ৫ অক্টোবর দুপুরে আছড়ে পড়া ভয়হ্কর সাইক্লোনের মোকাবিলা করেছিল সে। হাতে গোনা কয়েকটি গাছ বাদে সেদিন উপড়ে যায় শহরের প্রায় সব গাছ। বাদ যায়নি সেন্ট জেমস চার্চ এর বিপরীতে স্কুলের সামনে রাস্তার বিশাল অশ্বত্থ গাছও। প্রচুর ইট এবং টিনের বাড়ি, কয়েক হাজার টালি ও খড়ের বাড়ি ভেঙে পড়ে। উড়ে যায় গাড়ি, পালকি, বাড়ির চাল।

কাগজের মতো উড়ে যায় লোহার ছাউনি। ধ্বংস হয়ে যায় পূর্ব এবং দক্ষিণ শহরতলি। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় ফোর্ট উইলিয়ামের সামনের সাজানো রাস্তা থেকে অন্যান্য রাস্তাঘাট। জঙ্গলে পরিণত হয় ইডেন গার্ডেনস। রোমান ক্যাথলিক চার্চের উপরের অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। ক্ষতি হয় ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির অফিসের। নষ্ট হয়ে যায় সব টেলিগ্রাফ লাইন। খেজুরি ও হিজলি বন্দর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। জলোচ্ছ্বাস হয় ৪০ ফুট। ক্ষতি হয় বহু জাহাজের। ১৮৬৪ সালের সেই সাইক্লোন কেড়ে নিয়েছিল কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ।

কিন্তু সেই ঝড় বোটানিক গার্ডেনের বটগাছ সামলে দিয়েছিল অবলীলায়। তখন তো সে সবে ৯৪। শরীর জুড়ে তারুণ্যের জয়ধ্বনি।

তারপর ২০০৯-এ এল আয়লা, ২০১৯-এ বুলবুল এবং ফণী। কত ঝড় এল আর গেল....। মাথায় জট নিয়ে নিশিদিন দাঁড়িয়েছিল নির্লিপ্ত প্রাচীন বট।

কিন্তু সব ওলটপালট করে দিল উমপুন। শরীরের ক্ষত নিয়ে এখনও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বট। কিন্তু এই ক্ষতের থেকে বড় ক্ষত তার মনে। কারণ, তার আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদিনের বহু বন্ধু মহীরূহই আজ ধরাশায়ী।

বোটানিক গার্ডেন সূত্রে খবর, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত গাছগুলি সরিয়ে লাগানো হবে একই প্রজাতির নতুন গাছ। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত গাছগুলিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু হবে শীঘ্রই। শুক্রবার ঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন গার্ডেনের আধিকারিক ও বিজ্ঞানীরা। কীভাবে এই উদ্ভিদ উদ্যানকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে শুরু হয়েছে পরিকল্পনা।

নতুন সঙ্গীরা কবে আসবে, তারই অপেক্ষায় প্রাচীন বট।