১৯২২ সালের ১৮ মার্চ, আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে। এই দিনটিতেই বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল মহাত্মা মোহনদাস গাঁধীকে। ভারতের তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং অসন্তোষ উস্কে দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল। ইতিহাসে এই ঘটনাটিকে 'দ্য গ্রেট ট্রায়াল' বলা হয়। ওই বিচারে মহাত্মা গাঁধীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং ৬ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। যদিও দুর্বল স্বাস্থ্য এবং 'ভাল আচরণের' কারণে দুই বছর পরেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এটাই মনে করা হয় মহাত্মা গাঁধী অসাধারণ নৈতিক জয় অর্জন করেছিলেন। ইতিহাসে এমন বেশ কিছু বিচারপ্রক্রিয়া লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যা সভ্যতা, শালীনতা এবং শৌর্য্যের মাপকাঠির বিচারে ইতিহাসের পাতায় জায়গা পেয়েছে। ওই সমস্তক্ষেত্রে বিচারক নিজে বিব্রত হয়েছেন এবং যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি দোষ স্বীকার করে নিতে আগ্রহী হয়েছেন।
 
ওই বিচারপ্রক্রিয়ায় আইনের শাসনের প্রতি আনুগত্য এবং কোনও ব্যক্তির অনৈতিক কোনও আইনভাঙার অধিকার দুটির পক্ষেই সওয়াল করেছিলেন মহাত্মা গাঁধী।



১. চৌরিচৌরার ঘটনা, গাঁধীকে গ্রেফতার এবং ভারতে রাজনৈতিক বিচারপ্রক্রিয়া


সালটি ছিল ১৯২২। সেই সময় ভারতে পুরোদমে অসহযোগ আন্দোলন (noncooperation movement) চলছে।  ১৯২০ সালে মহাত্মা গাঁধী ওই আন্দোলন শুরু করেন। উত্তরপ্রদেশে গোরক্ষপুরের কাছাকাছি একটি গঞ্জ-শহর চৌরিচৌরা। ১৯২২ সালের চৌঠা ফেব্রুয়ারি, সেখানেই কংগ্রেস ও খিলাফত সমর্থকদের সঙ্গে হিংসাত্মক সংঘর্ষে ২৩জন পুলিশকর্মী মারা যান। সেই ঘটনার বিরোধিতা করেছিলেন মহাত্মা গাঁধী। এই ঘটনাকে সামনে রেখে তিনি বলেছিলেন যে দেশ এখনও স্বরাজের জন্য প্রস্তুত নয় এবং সেই কারণেই দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন তিনি।  


এই সিদ্ধান্তে বিস্মিত ও  হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন সেইসময়ের অধিকাংশ কংগ্রেস নেতা। কারও মত ছিল এই ধরনের সিদ্ধান্ত একমাত্র নিতে পারে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি। কারও কারও মত ছিল এই সিদ্ধান্ত নিয়ে গাঁধী ভুল করেছেন। কিন্তু গোটা বিষয়টি দৃঢ় মনোভাব দেখিয়েছিলেন মহাত্মা গাঁধী। ১৬ ফেব্রুয়ারি ইয়ং ইন্ডিয়া (young india) পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন যে, যাঁরা  দেওয়াললিখন পড়তে পারছেন না তাঁরা আসলে বুঝতে পারছেন না যে চৌরিচৌরার হিংসাত্মক ঘটনা দেখিয়েছে ভারত কোনপথে যেতে পারে যদি এখনই কোনও কঠোর সতর্কতা না নেওয়া হয়। 


অসহযোগ আন্দোলন রদ করার ফলে যদি দেশের নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হতো, তাহলে নিঃসন্দেহে ব্রিটিশরা স্বস্তি পেত। ১৯২০ সালের ডিসেম্বের গাঁধী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে এক বছরের মধ্যে ভারত স্বরাজ পাবে যদি ভারতীয়রা অহিংসার পথ মেনে আন্দোলন করেন। এক বছর পেরিয়ে গেলেও স্বরাজ মেলেনি, গাঁধীও ব্যর্থ হয়েছিলেন। ব্রিটিশরা ধরেই নিয়েছিল যে গাঁধীর বিশ্বাসযোগ্যতা ও সম্মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ৬ মাস ধরে বম্বে প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত সরকার এবং লন্ডনের ব্রিটিশ আধিকারিকরা চুলচেরা আলোচনা করে গিয়েছেন যে মহাত্মা গাঁধীকে গ্রেফতার করা উচিত কিনা, গ্রেফতার করলেও ঠিক কখন করা উচিত। কারণ ব্রিটিশ শাসনের দিকে প্রতি পদক্ষেপে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছিলেন মহাত্মা গাঁধী। ব্রিটিশ শাসনকে 'শয়তানসম' (satanic) বলে অভিহিত করেছিলেন।  ইয়ং ইন্ডিয়া (young india) পত্রিকায় প্রকাশিত গাঁধীর প্রতিটি লেখায় ব্রিটিশদের তীব্র বিরুদ্ধাচরণ ছিল এবং ব্রিটিশ শাসনকে উপড়ে ফেলার ডাকও দিচ্ছিলেন গাঁধী।    


১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত 'আ পাজল অ্য়ান্ড ইটস সলিউশন' (A puzzle and its solution) প্রবন্ধে তিনি দৃঢ় এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে লিখেছিলেন যে 'আমরা গ্রেফতারি চাই কারণ এই স্বাধীনতা আসলে দাসত্ব। আমরা এই সরকারের চ্যালেঞ্জ করছি কারণ আমরা এই সরকারের কার্যকলাপকে পুরোটাই খারাপ বলে মনে করি। আমরা সরকারে উৎখাত করতে চাই। আমরা চাই  যে মানুষের ইচ্ছের দাম দিয়ে সরকার মাথা ঝোঁকা।'


২৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত 'ট্যাম্পারিং উইথ লয়্যালিটি' (Tampering with Loyalty) প্রবন্ধে মহাত্মা গাঁধী ব্রিটিশ সরকারের সেনায় কাজ করা ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশ আনুগত্য ছাড়ার জন্য একটি বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, 'এই সরকার যেটি ভারতীয়দের মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, পাঞ্জাবে ভয়াবহ অমানবিক কাজ করেছে, তাদের জন্য সেনা হোক বা সাধারণ নাগরিক, যে কোনওভাবে কাজ করা আসলে পাপ।' সরকারের প্রতি এই ধরনের বার্তা দিলে, সরকারি কর্মচারীদের আনুগত্য ত্যাগের কথা বলার পরেও এমন ব্যক্তিকে গ্রেফতার না করলে তা আসলে সরকারকেই দুর্বল দেখাবে। 


অন্যদিকে মহাত্মা গাঁধীকে কারাগারের বাইরে রাখারও একাধিক ভাল যুক্তি ছিল। প্রতিটি দায়বদ্ধতা এবং বাধাকে সুবিধায় পরিণত করেছিলেন গাঁধী। ব্রিটিশরা মনে করছিল গাঁধীর প্রভাব কমছে, ফলে সেই সময় তাঁকে  জেলবন্দি থাকলে তিনি শহিদের মর্যাদা পেয়ে যেতে পারেন। এছাড়াও যখনই গাঁধী কারাগারে গিয়েছেন তখনই তিনি ফের একজন নবজীবনপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসাবে বেরিয়েছেন। এছাড়াও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যাঁরা হিংসার পথ নিয়েছিলেন তাঁদের প্রভাবকে ঠেকিয়ে সাধারণ জনমানসে অহিংসার পথে চলা মহাত্মা গাঁধীর প্রভাব অনেকটাই বেশি ছিল। ফলে মহাত্মা গাঁধীকে ঠিক তখনই গ্রেফতার করা হবে যখন তাঁর স্বাধীনতাকে আর সহ্য করা যাবে না।    


চৌরিচৌরা হিংসাত্মক ঘটনার পরে এবং অসহযোগ আন্দোলন স্থগিতের পর সেই সুযোগ এল ব্রিটিশদের সামনে। গাঁধীকে গ্রেফতারের পরে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ব্রিটিশরা ভেবেছিল, তাঁরা আইনের শাসনের দৃষ্টান্ত রাখছে। কোনও ঔপনিবেশিক শক্তি কোনও বিদ্রোহীকে মেরে দেয় অথবা কোথাও লুকিয়ে ফেলে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করে নিজেদের কাজ নিয়ে গর্ববোধ করেছিল ব্রিটিশরা। ঔপনিবেশিক ভারতে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের আঙিনায় রাজনৈতিক বিচারপ্রক্রিয়া অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। গাঁধীর আগেও বহু জাতীয়তাবাদী নেতাকে ভারতীয় দণ্ডবিধির 124A ধারার অধীনে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। 


এই বিচারপ্রক্রিয়ারও একটি ঝুঁকি ছিল। কারণ এখানে রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত পোষণকারীদের একটি মঞ্চ দেওয়া হয়েছিল যেখান থেকে তাঁরা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করতে পারে। জাতীয়তাবাদীদের একটি বড় অংশ আইনের বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন, কারও কারও আইনসংক্রান্ত বিষয়ে এবং বিচারসভা সম্পর্কে যথেষ্ট পারদর্শিতা ছিল।  


১৯০৮ সালে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তিলকের বিচারপ্রক্রিয়া ছিল এমনই একটি নিদর্শন। যেখানে ইংরেজ আইন এবং বিচার নিয়ে তিলকের জ্ঞানের প্রমাণ মিলেছিল। তবে এটাও ঠিক যে, রাজনৈতিক বন্দিদের বিচারের ক্ষেত্রে দোষীসাব্যস্ত হওয়াটা যেন আগে থেকেই ঠিক থাকত।


২. গাঁধীর বিচার নাকি রাষ্ট্রের বিচার?


গাঁধীকে বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে আনার জন্য তাঁকে কোনও একটি অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করতে হবে। তখন বেছে নেওয়া হয় ইয়ং ইন্ডিয়ার প্রবন্ধগুলিকে। সেগুলিকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে গণ্য করা হয়েছিল। তার মধ্যে তিনটিকে 'ব্রিটিশ ভারতে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা, অবমাননা এবং অসন্তোষ গড়ে তোলার চেষ্টা' হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই অভিযোগে 'রাষ্ট্রদ্রোহ' শব্দটি উপস্থিত ছিল না, তবে ধারা 124A IPC-টি ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত আইন থেকে আনা হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে, রাষ্ট্রদ্রোহকে রাজনৈতিক অপরাধের তালিকা থেকে বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু ভারতে ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ-বিরোধী কর্মসূচি দেখে ব্রিটিশরা মনে করেছিল যে ওই আইন ভারতে এবং তাদের অন্য উপনিবেশগুলিতেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। 


১৯২২ সালের ১১ মার্চ, মহাত্মা গাঁধীকে এবং ইয়াং ইন্ডিয়ার প্রকাশক শঙ্করলাল বাঙ্কারকে ম্য়াজিস্ট্রেটের সামনে আনা হয়েছিল। যখন গাঁধীকে তাঁর পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তিনি লিখেছিলেন তাঁতি এবং চাষি। আমরা জানি না এই লেখাটি দেখে আদালতের ক্লার্কের মুখের অভিব্যক্তি ঠিক কী হয়েছিল। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনে স্রষ্টা তাঁর পেশা সম্পর্কে ঠিক তথ্য দিচ্ছেন না। কিন্তু গাঁধী সত্যিই তাঁর আশ্রমে সবজি চাষ করেছিলেন। ভারতীয় কৃষকদের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল এবং কৃষকদের ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক তথা 'আত্মা' হিসেবে মনে করতেন তিনি। নিজেকে তাঁতি হিসেবে বর্ণনা করার মধ্যেও এই ভাবনাটি লুকিয়ে ছিল। ঔপনিবেশিক রাজত্বে নৈতিকতা এবং রাজনীতির যে বুনন গাঁধী তৈরি করেছিলেন তার সঙ্গেও এটি মিলে যায়। এর সঙ্গে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে গাঁধীর পরিচয়ের সঙ্গে চরকা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং শ্রমের প্রতি তাঁর গভীর বিশ্বাসের অন্যতম প্রমাণ। একজন নম্র কৃষক এবং তাঁতি, অহিংসপথে আন্দোলনের জনক একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছিল।


এক সপ্তাহ পরে, ১৮ মার্চ দুপুরে, গাঁধীকে শাহীবাগের সার্কিট হাউসে আনা হয়। তখন আদালত কানায় কানায় পূর্ণ। আহমেদাবাদ এবং সবরমতি আশ্রমের গাঁধীর কিছু ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন জওহরলাল নেহেরু এবং সরোজিনী নাইডু। গাঁধী ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়ালেন।  নাইডু লিখেছেন, 'মহাত্মা গাঁধী যখন আদালতে প্রবেশ করেছিলেন তখন স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল৷' আইসিএস, জেলা ও দায়রা জজ রবার্ট ব্রুমফিল্ডের ডায়েরি এই ঐতিহাসিক ঘটনার বিষয়ে খুব কম তথ্য দেয়। শুধুমাত্র বিচারপ্রক্রিয়ার রেকর্ড নিম্নলিখিত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে সেখানে...


বম্বে প্রেসিডেন্সির অ্যাডভোকেট-জেনারেল স্যার থমাস স্ট্র্যাংম্যান দ্বারা প্রসিকিউশন পরিচালিত হয়েছিল; অভিযুক্তরা নিজেদের সিদ্ধান্তে উকিল নেয়নি। প্রথমে অভিযোগগুলো পড়ে শোনানো হলো। যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তাঁরা কী বলবেন? তখন দুজনেই উত্তর দিয়েছিলেন 'দোষী'। এটা মনে হয় যে, গাঁধী সবসময়ই ব্রিটিশদের কাছে একটি রহস্য ছিলেন। ব্রিটিশরা কখনও বুঝে উঠতে পারেনি যে গাঁধী আদতে একজন 'সাধু' ছিলেন নাকি 'রাজনীতিবিদ'। নিজেকে যিনি খ্রিস্টান বলে থাকেন, তাঁর চেয়েও গাঁধিকে বেশি ভাল খ্রিস্ট্রান মনে হয়েছে ব্রিটিশদের। এভাবেই নিপীড়কদের পিছু হঠানো সম্ভব করেছিলেন গাঁধী।


যেহেতু অভিযুক্তরা দোষ স্বীকার করেছিলেন, তাই একটি দীর্ঘ বিচারের প্রয়োজন ছিল না। ব্রুমফিল্ড সাজা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। অ্যাডভোকেট-জেনারেল অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের গুরুত্ব বর্ণনা করে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। তারপর ব্রুমফিল্ড দণ্ড বা সাজার বিষয়ে বিবৃতি দেওয়ার সুযোগ দেন অভিযুক্তদের।


গাঁধী তাঁর সঙ্গে একটি লিখিত বিবৃতি নিয়ে এসেছিলেন। তিনি যেভাবে লেখা শুরু করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে বিচারককে হতবাক করে দিয়েছিল। গাঁধী স্বীকার করেছিলেন যে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ শুরু করার জন্য় আগুন নিয়ে খেলেছেন। এটাও তিনি জানেন যে তাঁর দেশবাসী তাঁর মতো অহিংসার ধারণার সঙ্গে সেভাবে সম্পৃক্ত নয়। তিনি চৌরিচৌরার ঘটনার জন্য দায় স্বীকার করেন এবং তাঁর জন্য নিজে আইনের চোখে 'সর্বোচ্চ শাস্তি' মেনে নিতেও প্রস্তুত বলে ঘোষণা করেছিলেন। কারণ তা 'একজন নাগরিকের সর্বোচ্চ কর্তব্য'। তিনি আরও বলেছিলেন যে বিচারক তাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়ান অথবা তাঁকে কঠোরতম শাস্তি দিন, যদি বিচারক বিশ্বাস করেন যে এই আইন সত্যিই জনগণের জন্য ভাল।


লিখিত বক্তব্যের পরের অংশটি ছিল আরও শক্তিশালী এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক অভিযোগ। এটি ভারতের স্বাধীনতাস আন্দোলনের একটি সনদ, বিশ্ব ইতিহাসে ঔপনিবেশিকতা বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং রাজনৈতিকভাবে একটি মাস্টারওয়ার্ক। গাঁধী তাঁর লেখায় বর্ণনা করেছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একজন অনুগত প্রজা থেকে কীভাবে তিনি একজন রাষ্ট্রদ্রোহীতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছেন যে ব্রিটিশদের সংসর্গে ভারত অসহায়, আগ্রাসন প্রতিরোধে অক্ষম এবং জনগণের জন্য অক্ষম হয়ে উঠেছে।


মহাত্মা গাঁধী সৎ উদ্দেশ্যের ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সম্পর্কে বলেন, 'ব্রিটিশ ভারতে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকার জনসাধারণের শোষণের জন্য পরিচালিত হয়, এটা তাঁরা খুব কমই উপলব্ধি করেন।' তিনি আরও বলেন, 'কোনও কুতর্ক, কোনও পরিসংখ্যানগত গোঁজামিল খালি চোখে দেখা গ্রামের কঙ্কালসার পরিস্থিতির বিষয়টি চাপা দিতে পারবে না।' ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্য নিয়ে আইনের মারপ্যাঁচ, শোষণ, প্রমাণের সঙ্গে কুতর্ক মিশিয়ে, ছলচাতুরি করা: এই সমস্ত কিছু অলঙ্কারশাস্ত্রের একটি নিপুণ আদেশ, ইংরেজির বাগধারা, এবং দার্শনিক যুক্তি, এবং একটি একটি পারফরমেটিভ স্পেস হিসাবে কোর্টরুমের সচেতনতা ভেদ করা। এই অভিযোগটি একই সঙ্গে গদ্যের মতো সরল এবং তীক্ষ্ণ বাগশক্তি সম্পন্ন। গাঁধীর পর্যবেক্ষণ, 'ভালবাসা আইন দিয়ে তৈরি বা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না'... আইন ঘৃণা বক্তব্যকে অপরাধ হিসেবে বলতে পারে, কিন্তু অন্যদের ভালবাসতে শেখাতে পারে না।


গাঁধী বলেছিলেন যে তিনি বিচারকের পক্ষ থেকে 'রূপান্তর' আশা করেননি। কিন্তু ব্রুমফিল্ড স্পষ্টতই প্রভাবিত হয়েছিলেন।  'আইন কোনও ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়' - এটা বলার পরেও তিনি অস্বীকার করতে পারেননি যে গাঁধী 'অন্য ধাতের মানুষ' যা তিনি আগে দেখেননি। তিনি এই সত্যকে উপেক্ষা করতে পারেননি যে 'লক্ষ মানুষের দৃষ্টিতে' গাঁধী একজন মহান দেশপ্রেমিক, একজন মহান নেতা এবং অবশ্যই 'উচ্চ আদর্শের এবং সাধুর মতো জীবনযাপনকারী একজন ব্যক্তি।'


যদিও একজন বিচারক হিসেবে তাঁর দায়িত্ব গাঁধীকে 'আইনের অধীনস্থ একজন মানুষ হিসেবে' বিচার করা, যিনি নিজেই আইন ভাঙার কথা স্বীকার করেছেন। ব্রুমফিল্ড গাঁধীকে ছয় বছরের সাধারণ কারাদন্ডের সাজা দেন এবং এটাও বলেন যে সরকার যদি তাঁর সাজা কমানোর সুযোগ পায় তবে তাঁর চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবেন না। এই বিচারপ্রক্রিয়া অসাধারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কেউ কেউ এটাকে শৌর্য্য় বা বীরত্ব বলতে পারেন। এই বিচারকেরও ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছিল। সরোজিনী নাইডুর ভাষায়, 'মানুষের আবেগ এমনভাবে বিস্ফোরিত হয়েছিল যেন তা দুঃখের ঝড়। মহাত্মাকে বিদায় জানাতে ধীরে এবং বিশাল একটি মিছিল তাঁর দিকে অগ্রসর হয়েছিল।' কেউ কেউ গাঁধীর পায়ের কাছে পড়ে গিয়েছিলেন, কেঁদে ফেলেছিলেন। ইংরেজ মালিকানাধীন দ্য বম্বে ক্রনিকলস (The Bombay Chronicle) যেটি জাতীয়বাদী আন্দোলনের পাশে ছিল, সেটির প্রতিবেদক মনে করেছিলেন, 'বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ'-এর বিচার 'সক্রেটিসের কথা মনে করায়, শিষ্যদের মধ্যে দিয়ে শেষ সময়েও যিনি ধীর এবং হাসিখুশি ছিলেন। পরিস্থিতি এমনই হয়েছিল যে যদি দর্শকরা মনে করেন যে আদতে বিচারের কাঠগড়ায় রাষ্ট্র ছিল, তাহলেও  তাঁদের ক্ষমা করে দেওয়া যায়।  


লেখক একজন লেখক, ব্লগার, সাংস্কৃতিক সমালোচক এবং ইউসিএলএ-তে ইতিহাসের অধ্যাপক।


(বিশেষ দ্রষ্টব্য - উপরিউক্ত লেখাটির পরিসংখ্যান, দাবি ও  মতামত লেখকের নিজস্ব। এবিপি লাইভের সম্পাদকীয় কোনওরকম প্রভাব এতে নেই। লেখাটির বিষয়ে এবিপি কোনওরকম মত পোষণ করে না।)