বেজিং: সার্বিক নিরিখে এগিয়ে থাকলেও, উদ্বেগ বাড়াচ্ছে জন্মের হার, প্রবীণ জনসংখ্যা। জনসংখ্যায় ভারসাম্য আনতে তাই উদ্যোগী হল চিন। জন্মহার বাড়ানোর সুপারিশ করল সে দেশের সরকার। তাতে শামিল হয়ে অভিনব পদক্ষেপ চিনা কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির। এপ্রিল মাসে সেখানে পড়ুয়াদে গণছুটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, যাতে যুবসমাজ প্রেমে পড়ে, পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সম্পর্ককে। 


সরকারি সুপারিশ মেনে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিনের ন'টি কলেজ। এর মধ্যে ফাং মি এডুকেশন গ্রুপই সর্বপ্রথম পদক্ষেপ করে। তাদের অধীনস্থ মিয়াংইয়াং ফ্লাইং ভোকেশনাল কলেজ ২১ মার্চ বসন্তকালীন ছুটি ঘোষণা করে। প্রেম, সম্পর্ককে প্রাধান্য দিতেই এই ছুটি। এই ছুটিতে পড়ুয়াদের প্রেমে পড়তে, সম্পর্কের জটিলতা মিটিয়ে নিতে, প্রিয়জনের সঙ্গে সময় একান্তে সময় কাটাতে বলা হয়েছে।


মিয়াংইয়াং ফ্লাইং ভোকেশনাল কলেজের ডেপুটি ডিন লিয়াং গুয়োহুই লিখিত বিবৃতিতে বলেন, 'আশাকরি পড়ুয়ারা সবুজ দেখতে যাবেন, পাহাড়ে ঘুরবেন এবং বসন্ত উপভোগ করবেন। এতে পড়ুয়াদের মনের ব্যাপ্তিই ঘটবে না শুধুমাত্র, ক্লাসরুমও সমৃদ্ধ  হবে'। শুধু তাই নয় ছুটিতে পডুয়াদের যে হোমওয়র্ক দেওয়া হয়েছে, তা-ও অভিনব। ছুটিতে মনে কী ভাবনার উদ্রেক ঘটে, ব্যক্তিত্বের উন্মেষ কতটা ঘটল, প্রিয়জনের সঙ্গে সমীকরণ ঠিক কোথায়, তা ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করতে বলা হয়েছে। বেড়ানোর ভিডিও রেকর্ডিং করতেও উৎসাহিত করা হয়েছে পড়ুয়াদের। জন্মহারবৃদ্ধিতেই এত তোড়জোড় বলে জানা গিয়েছে।


জন্মহারবৃদ্ধিতে চিনা সরকারের তরফে ২০ ধরনের সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু জন্মহার উদ্বেগ জনক জায়গায় এসে পৌঁছনোর নেপথ্যে চিনের এক সন্তান নীতিই দায়ী বলে মত বিশেষজ্ঞদের। জনসংখ্যায় বিস্ফোরণ ঘটবে বলে একের পর এক রিপোর্ট সামনে আসছে যখন, সেই সনয় এক সন্তান নীতির আশ্রয় নেয় চিন।


আরও পড়ুন: World Population: সাধারণ মানুষ নন, পরিবেশ ধ্বংসের নেপথ্যে ধনকুবেররা! শতাব্দী শেষ হতে হতে কমবে জনসংখ্যা, বলছে গবেষণা


১৯৮০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চিনে সেই একসন্তান নীতি কায়েম ছিল, যার আওতায় একটি মাত্র সন্তানধারণের অধিকার ছিল নাগরিকদের। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়। লিঙ্গ বৈষম্য দেখা দেয় যেমন, তেমনই ভারসাম্য়হীন হয়ে পড়ে দেশের জনসংখ্যা। মোট জনসংখ্যা তরুণ প্রজন্মের পরিবর্তে প্রবীণ নাগরিক নির্ভর হয়ে পড়ে, যা কোনও দেশের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যতের জন্য অনুকুল নয় একেবারেই।


বিপদ টের পেয়ে তাই একসন্তান নীতি থেকে সরে আসে চিন। ২০১৫ সালে প্রথমে দুই সন্তান এবং পরে, ২০২১ সালে সর্বাধিক তিনটি সন্তান নেওয়া যেতে পারে বলে ঠিক করে চিন সরকার। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্মব্যস্ত জীবনে চিনের তরুণ প্রজন্মের হাতে পরিবারের জন্য় সময়ই নেই। আবার অর্থনৈতিক কারণে, সন্তানপালনের খরচ, জীবনধারণের খরচ, লিঙ্গ বৈষম্যের কথা ভেবেও সন্তান ধারণে অনীহা তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, করোনা অতিমারির সময় গৃহবন্দি হয়ে থাকলেও, চিনা দম্পতিদের মধ্যে সন্তানধারণে অনীহা দেখা যায়। এমনকি ইদানীং কালে চিনের তরুণ প্রজন্ম বিবাহেও অনাগ্রহী বলে উঠে আসছে তথ্য।


তাতেই জন্মহারবৃদ্ধির বিষয়টি সম্প্রতি নিজের হাতে তুলে নেয় চিন সরকার। মার্চ মাসে চায়না'জ পিপল'স পলিটিক্যাল কনসাল্টেটিভ বার্ষিক কনফারেন্সে জন্মহারবৃদ্ধির প্রসঙ্গ ওঠে। সেখানে শুধুমাত্র দ্বিতীয় সন্তানের জন্য নয়, তৃতীয় সন্তানধারণের ক্ষেত্রেও নাগরিকদের ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তাব জমা পড়ে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচের কথা ভেবে যাতে পিছিয়ে না আসেন মা-বাবারা, তার জন্য সরকারি শিক্ষা বিনামূল্যে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া, মেয়েদের স্বাস্থ্য সংংক্রান্ত চিকিৎসার উন্নতির প্রস্তাবও দেওয়া হয়। 


বিগত ছয় দশকে, গত বছরই প্রথম দেখা যায়, চিনের জনসংখ্যার সঙ্কোচন ঘটছে। জন্মহার বৃদ্ধির গতি ঝিমিয়ে পড়েছে। তাই সরকারের তরফে বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, ২০২০ সালের শেষে চিনের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৪১ কোটি, যা এক দশকে বাড়ে মাত্র ৫.৪ শতাংশ। জানা যায়, চিনে প্রতি মহিলার গড়ে সন্তান প্রসবের সংখ্যা বা ফার্টিলিটি রেট মাত্র ১.৩,  জনসংখ্যায় ভারসাম্য আনতে যা হওয়া উচিত ২.১। বর্তমানে সেখানে মেয়েদের ফার্টিলিটি রেট আরও কমে ১.২ হয়েছে। আবার বার্ধক্য প্রবীণ জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে, কর্মক্ষম নাগরিকের সংখ্যা উদ্বেগজনক জায়গায়।


তবে শুধু চিনই নয়, জন্মহার নিয়ে গোটা বিশ্বকে সতর্কবার্তা দিয়েছে অলাভজনক সংস্থা 'দ্য ক্লাব অফ রোমে’র নয়া গবেষণা। তার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমানে জন্মহার যে জায়গায় রয়েছে, এই ধারা বজায় থাকলে আগামী দিনে পৃথিবীর জনসংখ্যা কমবে বই বাড়বে না।  বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭৯৬ কোটি। চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি তা সর্বোচ্চ ৮৬০ কোটিতে গিয়ে ঠেকতে পারে। কিন্তু শতাব্দী শেষ হতে হতে তা আরও ২০০ কোটি কমে যেতে পারে বলে জানানো হয়েছে।