তেহরান: মাথার হিজাব আলগা করে বাঁধা রয়েছে মনে হওয়ায় গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ২২ বছরের মেহসা আমিনিকে (Mahsa Amini)। বলা হয়েছিল, হিজাব পরা, আচার-আচরণের শিক্ষা দেওয়া হবে তরুণীকে (Hiran Anti Hijab Protests)। কিন্তু তার পর আর বাড়ি ফেরা হয়নি মেহসার। হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছিল তাঁর নিথর দেহ। সরকার মদতপুষ্ট নীতি পুলিশই মেহসাতে হত্যা করেছে বলে দাবি পরিবারের। তা নিয়ে বিগত দুই মাস ধরে আগুন জ্বলছে ইরানে। পুলিশের গুলি, নৃশংসতার মুখে দাঁড়িয়েও প্রতিবাদ, আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ (Iran Protests)। তাতে আন্তর্জাতিক মহলে যেমন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ইরান সরকার, তেমনই ছড়িয়ে পড়ছে ভুয়ো খবরও। তার স্বীকার হলেন খোদ কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডোও। আন্দোলনকারী ১৫ হাজার মানুষকে ইরান সরকার মৃত্যুদণ্ডের সাজা শুনিয়েছে বলে ট্য়ুইট করেন তিনি। ভুল বুঝতে পেরে যদিও পরে ট্যুইট মুছে দেন তিনি, তবে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতেই ভুয়ো খবরের রমরমা বাড়ছে বলে মত কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের (Death Sentences in Iran)।


ইরানে মুড়ি-মুড়কির মতো মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার খবর ছড়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায়


চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর দাদা কিয়ারেশ আমিনির সঙ্গে শহিদ হাঘানি এক্সপ্রেস হয়ে কুর্দিস্তান থেকে তেহরান যাচ্ছিলেন মেহসা। সেই সময় রাস্তায় পুলিশ তাঁদের গাড়ি আটকায় বলে অভিযোগ পরিবারের। মেহসার পরিবারের দাবি, হিজাবে মাথা ঢাকা ছিল মেহসার। কিন্তু পুলিশ জানায়, আলগা ভাবে হিজাব জড়িয়েছেন মেহসা। তাই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। ডিটেনশন শিবিরে নিয়ে গিয়ে হিজাব পরার পাঠ দেওয়া হবে বলে জানায় পুলিশ। এক ঘণ্টার মধ্যে মেহসাকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানায়। কিন্তু পরে কাসরা হাসপাতালে মেহসার খোঁজ মেলে বলে অভিযোগ পরিবারের। মেহসার পরিবার জানিয়েছে, হাসপাতালে ব্রেনডেড অবস্থায় নিয়ে আসা হয় মেহসাকে। তাঁর মাথায় এবং পায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। মেহসার কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ার দাগ ছিল বলেও দাবি করেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। মেহসাকে পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলে বলে অভিযোগ তাঁর পরিবারের।


হাসপাতালে মেহসার স্ক্যান রিপোর্ট বলে কিছু ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয় কিছু হ্যাকার। তাতে মাথার খুলিতে আঘাতের চিহ্ন, ফোলা ভাব স্পষ্ট দেখা যায়। পুলিশ-প্রশাসন যদিও তা অস্বীকার করে। প্রশ্ন তোলে রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে। তবে তাতেও আন্দোলন থামেনি। জায়গায় জায়গায় একজোট হয়ে প্রতিবাদ চলছে দেশ জুড়ে। আগুনে হিজাব, স্কার্ফ খুলে জ্বালিয়ে দেওয়ার দৃশ্যও সামনে এসেছে। এখনও পর্যন্ত যে খবর মিলেছে, তাতে ১৫ হাজার আন্দোলনকারী গ্রেফতার হয়েছেন ইরানে। সংবাদমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সবমিলিয়ে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে সে দেশের আদালত।  জাতীয় নিরাপত্তা ভঙ্গ, শান্তি নষ্ট, সরকারি দফতরে অগ্নিসংযোগ এবং অপরাধমূলক কাজকর্মের ধারা প্রয়োগ করা হয় তাঁদের উপর।


আরও পড়ুন: NASA Artemis 1: অবশেষে এল সাফল্য, চাঁদের সফলভাবে আর্টেমিস ১ পাঠাল নাসা, দেখুন ভিডিও


প্রথমে আমেরিকার একটি সংবাদমাধ্যম এই ১৫ হাজার পরিসংখ্যানটি তুলে ধরে। সেই সূত্র ধরেই ট্রুডো ট্যুইটারে লেখেন,‘ইরান সরকারের তরফে ১৫ হাজার আন্দোলনকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বর্বরোচিত সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করছে কানাডা’। ভুল বুঝতে পেরে এর পর ট্যুইট মুছে দেন ট্রুডো। আমেরিকার সংবাদমাধ্যমটি তথ্য সংশোধন করে। কিন্তু ১৫ হাজারের মৃত্যুদণ্ডের তত্ত্ব ছড়াল কোন পথে (Iran Death Sentence Fact Check)? কূটনীতিকদের মতে, ইরানের ২৯০ জন সাংসদের মধ্যে ২২৭ জন সম্প্রতি একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। তাতে লেখা ছিল, সর্বশক্তিমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা (মোহারবা) করেছেন কিছু মানুষ। তাদের বিরুদ্ধে এমন কড়া পদক্ষেপ করতে হবে, যাতে উদাহরণ তৈরি হয়।


ইরানে ‘মোহারবা’র শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই, ‘পৃথিবীকে দূষিত করা’র ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয় এই শব্দবন্ধ। তাতেই গ্রেফতার হওয়া ১৫ হাজারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতে পারে বলে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি গ্রেফতার হওয়া সকলের উপর ‘মোহারবা’ কার্যকর হবে বলে২২৭ সাংসদ স্বাক্ষরিত লিখিত একটি নথিও ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়, পরে যা ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়। কারণ তাতে প্রাক্তন সাংসদদেরও নাম দেখা যায়। দেশের সাংসদরা যদিও গোড়াতেই জানান, সকলের মৃত্যুদণ্ডের কথা বলেননি তাঁরা।


দুই মাস পেরোতে চললেও আন্দোলনে উত্তাল ইরান


তবে সংখ্যা ১৫ হাজার না হলেও, ইরানে আন্দোলনকারীদের মৃত্যুদণ্ডের সাজা আটকে নেই। বুধবারই আরও চার জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা জানিয়েছে সে দেশের বিচার বিভাগ। এর মধ্যে দু’জন প্রকাশ্য রাস্তায় ছুরি হাতে আতঙ্ক তৈরি করেন, এক জন পুলিশকে গাড়ি চাপা দেন এবং চতুর্থ জন অস্থিরতা তৈরির মূল চাঁই বলে জানানো হয়েছে। এ ছাড়াও, জাতীয় নিরাপত্তাকে এগিয়ে রেখে পাঁচ থেকে ১০ বছরের সাজা শোনানো হয়েছে কয়েক জনকে। তবে গোটাটাই প্রাথমিক রায়, সাজাপ্রাপ্তরা আবেদন জানানোর সুযোগ পাবেন বলে জানিয়েছে ইরানের বিচার বিভাগ। তবে তাতেও আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। বরং এখনও কাতারে কাতারে মানুষ রাস্তায় রয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনের দাবিতে সিলমোহর না দিলেও, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৪০ জনের বেশি মৃত্যু হয়েছে বলে মেনে নিয়েছে ইরান সরকারও।