কলকাতা: ঐতিহাসিকভাবে বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজো করেন এখনকার বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের জমিদার কংস নারায়ন। তিনি নিজের কৃতিত্বে সম্রাট আকবরের কাছ থেকে রাজা উপাধি পান। কথিত আছে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে তাঁর দুর্গাপুজোয় সাড়ে আট লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল। সেটাও ছিল শারদীয়া অকালবোধন। সময়টা ১৫৭০- ১৫৯০ এর মধ্যে। এর কিছুদিন পরেই ১৬১০ সালে কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী ঠাকুরদালানে প্রথম দুর্গাপুজো হয়।

রাজা কংসনারায়ণের পরেও দীর্ঘদিন সমাজে দুর্গাপুজোর প্রবল উপস্থিতি দেখা যায়নি। কিছু রাজা এবং জমিদারের আঙিনার ভিতরে দুর্গাপুজোর চর্চা চলে এসেছে। ইংরেজরা এ দেশে আসার পর তাদের আনুকুল্যে একদল বাঙালি ক্রমশ ধনী ও প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন। নিজেদের আধিপত্য ও প্রতিপত্তি দেখাতে এরা প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের বাড়িতে দুর্গাপূজার প্রচলন করলেন।
বাড়ির পুজো বারোয়ারি পুজোর চেহারা নেয় কংস নারায়ণের প্রায় ২০০ বছর পর। হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় সেন বাড়ির পূজোতে অংশ না নিয়ে ১২ জন বন্ধু মিলে পৃথকভাবে পুজো করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১২ জন বন্ধু বা ইয়ারের হাতে তৈরি পুজো হয়ে উঠল বাংলার প্রথম বারোয়ারি। তবে তা ছিল জগদ্ধাত্রী পুজো। সেটা ১৭৬০এর দশক। মতান্তরে ১৭৯০। কলকাতায় প্রথম বারোয়ারি দুর্গা পুজো ধরা হয় সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পুজো কে। ১৯০৯ সালে ভবানীপুরে আদি গঙ্গার তীরে বলরাম বসু ঘাট রোডে শুরু হওয়া এই পুজো আজও চলছে।

কয়েক জন বন্ধু বা সমমনস্ক মিলে গড়ে ওঠা বারোয়ারি ক্রমে পাড়ার সবাইকে জড়িয়ে নিয়ে সর্বজনীন উৎসব এর চেহারা নিল। কলকাতায় সর্বজনীন দুর্গাপুজোর ইতিহাসও শতবর্ষ পেরিয়েছে।

পরাধীন ভারতে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে এই বাংলায় বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সংগঠিত হত। সেই উত্তরাধিকার বহন করছে বাগবাজার সর্বজনীনের বীরাষ্টমী ব্রত। বাঙালির অন্যতম আইকন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও বহু দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল বাগবাজার সর্বজনীন এবং কুমারটুলি সর্বজনীন।

ইংরেজরা এ দেশে আসার পর একদল বাঙালি ব্যবসা করে প্রবল ধনী হয়ে উঠলেন। তাঁরা নিজেদের সামাজিক প্রতিপত্তি দেখাতে বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু করলেন। এইসব বাড়ির পুজোর জৌলুস এক সময় প্রবাদে পরিনত হলো। সে যুগের কলকাতায় বলা হত মা দুর্গা মর্ত্য এসে প্রথমে শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে সাজগোজ করেন। তারপর কুমারটুলিতে অভয়চরণ মিত্রের বাড়িতে ভোগ খান এবং সবশেষে শোভাবাজারে নবকৃষ্ণের বাড়িতে নাচ গান দেখে আমোদ করেন।

অশোক গুপ্তর করা ১৯৬২ সালের প্রতিমা

এই সময় ধনী বাঙালী ব্যবসায়ীরা নিজেদের পুজোর আড়ম্বর দেখানোর এক অলিখিত প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। কে কত দামি জিনিস দিয়ে দুর্গাকে সাজাবেন তারই অভিনবত্ব খুঁজতে গিয়ে বিদেশ থেকে মূলত জার্মানি থেকে বিশেষ ধরনের রাংতার সাজ আনানো হয়েছিল। ডাকযোগে সেই সাজ এসে পৌঁছয় কলকাতায়। তার থেকেই ওই ধরনের বিশেষ রাংতার সাজকে ডাকের সাজ বলা হয়।

১৯৩৮ সালে দুর্গাপুজোর পঞ্চমীর দিন পুড়ে গেল কুমারটুলি সার্বজনীন এর প্রতিমা। একদিনের মধ্যে নতুন করে প্রতিমা তৈরি করতে হবে। তাড়াহুড়োতে একচালার প্রতিমা তৈরি না করে অনেকে মিলে আলাদা আলাদা করে পাঁচটা ঠাকুর তৈরি করলেন। সেই প্রথম একচালা ভেঙে পাঁচ চালা হল প্রতিমা। নেতৃত্বে শিল্পী গোপেশ্বর পাল বা জি পাল। এরপর বেশ কয়েক বছর প্রথাগত প্রতিমার বদলে না না ধরনের পরীক্ষামূলক প্রতিমা তৈরি করেন তিনি।

জি পালের অনবদ্য সৃষ্টি

উত্তর কলকাতায় রাজবল্লভ পাড়ার মুখে জগৎ মুখার্জি পার্ক। সেখানে ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত প্রতিমা তৈরি করেছিলেন শিল্পী অশোক গুপ্ত। প্রতিমা নিয়ে নানান ধরনের পরীক্ষামূলক কাজ তিনি করে গিয়েছেন। বলা যেতে পারে থিম পুজোর সেই শুরু। তাঁর প্রতিমাতে বরাবরই ধরা দিয়েছে সমকালীন প্রেক্ষাপট। সত্যজিৎ রায় সহ বহু মানুষ সেই মাঠে আসতেন অশোক গুপ্তের কাজ দেখতে। একদিকে দেবব্রত বিশ্বাসের গান আরেকদিকে অশোক গুপ্তর প্রতিমা এই হয়ে উঠেছিল জগৎ মুখার্জি পার্ক এর পুজোর পরিচয়। যদিও এই পুজোর পোশাকি নাম হল 1 নম্বর ওয়ার্ড সাধারণ দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী।