হায়দরাবাদ: বাতাসে পুজোর গন্ধ। আর সেই গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে এই বাংলার বাইরে। পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত দেশ বিদেশের উদ্যোক্তারাও। সেজে উঠছে পুজো মণ্ডপ। চলছে শেষ মুহূর্তে উমা বরণের প্রস্তুতি। দুবছর করোনা শঙ্কা কাটিয়ে এবারের উৎসব একটু বেশি আবেগের এবং উন্মাদনার। প্রতি বছরের মতো এবছরেও পুজোর আয়োজন করেছে হায়দরাবাদ বাঙালি সমিতি। ঐতিহ্যকে পাথেয় করেই পুজোর আয়োজন উদ্যোক্তাদের। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অবারিত দ্বার হায়দারবাদের প্রাচীন এই পুজো কমিটির।
পুজোর প্রস্তুতি শুরু প্রবাসে: করোনার আবহেই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে দিনযাপন। গত দু বছর নানা স্বাস্থ্য বিধি পেরিয়ে এবার উৎসবে অনেকটা শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে উৎসব প্রিয় বাঙালি। আকাশে রোদ-বৃষ্টির ফাঁকে পেঁজা তুলোর মেঘ জানিয়ে দিচ্ছে, হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন। এই মুহূর্তে তাই চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ চলছে। বাড়ির পুজো থেকে বারোয়ারি- সেজে উঠছে অভিনব সব সাজে। তবে দুর্গাপুজো ঘিরে উন্মাদনা শুধু এই বঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয়। দুর্গাপুজোর উৎসবে বাংলা আর হায়দরাবাদ মিলেমিশে একাকার।
হায়দরাবাদে এক টুকরো বাংলা: পুজো মানে তো শুধু বিধিবিধান, রীতিনিয়ম নয়। পুজো মানেই সকলের সঙ্গে দেখা। অনেক স্মৃতি ঝালিয়ে নেওয়া। আলিঙ্গনে বুঝিয়ে দেওয়া পাশে আছি। করোনার কাঁটা পেরিয়ে সদূর দক্ষিণ ভারতও এবার সেজে উঠছে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসবে। ঐতিহ্যকে বজায় রেখে রীতি মেনেই পুজোর আয়োজন করছে হায়দরাবাদ বাঙালি সমিতি। যে পুজোর বয়স ৮০ বছর। তবে দক্ষিণ ভারতের এই পুজো প্রাঙ্গনে এসে দাঁড়ালে মনেই হবে না, বাংলা থেকে কয়েকশ মাইল দূরে কোনও জায়গা। নিজামের শহরে এক টুকরো বাঙালিআনার ছোঁয়া। এক চালা, ডাকের সাজ, ঢাক, কাসর ঘণ্টার শব্দ বুঝিয়ে দেবে, দু্র্গাপুজো আদতেই বিশ্বজনীন। ষষ্ঠী থেকে দশমী, পুজোয় বাদ যায় না কোনও আচার-অনুষ্ঠান। প্রবাসে পুজো তো কী? রীতি মেনে নবপত্রিকা, সন্ধিপুজো, আরতি, দর্পণ বিসর্জন, সবই হয় নিয়ম নিষ্ঠা ভরে। বাঙালির অন্তরের পুজো দেখতে আসেন অবাঙালিরাও। পুজো মণ্ডপে বাংলার পূজারীদের পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতীয়দের নাগরিকদের অংশগ্রহণ থাকে চোখে পড়ার মত।
হায়দরাবাদ বাঙালি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয় কুমার দত্ত বলেন, “কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরাই প্রতিমা তৈরি করেন। প্রায় ২০-২২ দিন আগে মা চলে আসেন এখানে। তারপর হয় শেষ পর্যায়ের কাজ। ঐতিহ্যকে বজায় রেখেই এক চালার ঠাকুর হয়। ডাকের সাজেই সাজানো হয় প্রতিমা। তবে কলকাতার পুজোর সঙ্গে কোনও পার্থক্য নেই। বোধন থেকে বিসর্জন, নবপত্রিকা স্নান, সন্ধিপুজো, অঞ্জলি, সব কিছুই হয় একেবারে নিয়ম মেনে। পাশাপাশি ভোগের আয়োজনও করা হয়ে থাকে। এখনও এই পুজো করে থাকেন বাংলার পুরোহিতরাই। পুজো উদ্যোক্তা থেকে প্রবাসী বাঙালি তো বটেই, এই পুজোয় অংশ নেন অবাঙালিরাও।’’
কীভাবে শুরু হয়েছিল এই পুজো? শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৮২ বছর আগে। সালটা ১৯৪০ থেকে ১৯৪২-এর মধ্যে। দক্ষিণ ভারতের এই অঞ্চলে থাকতে শুরু করে প্রায় ১৫ থেকে ৫০টা বাঙালি পরিবার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, সরোজিনী নাইডু, তৎকালীন নিজাম রেলের প্রধান আর এন চক্রবর্তী। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কাহিনি সবারই জানা। ওপার বাংলা থেকে আরও বেশ কিছু বাঙালি পরিবার হায়দরাবাদ এসে থাকতে শুরু করেন। প্রথম বছর কোনও মূর্তি নয়, ঘট পুজোর মাধ্যমে দুর্গাপুজোর শুরু। পি এল মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে এই পুজোর আয়োজন করা হয় হনুমান টেকডি রেসিডেন্সে। এই পুজোয় প্রথম প্রতিমা তৈরি করেন আর্ট কলেজের অধক্ষ্য এস কে মণ্ডল। পরবর্তীকালে প্রতিমা তৈরি করে কার্তিক চন্দ্র পাল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এই পুজোর ব্যপ্তি। উৎসবের দিনগুলিতে কার্যত মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয় পুজো প্রাঙ্গন। ১৯৭৫ সালে হায়দরাবাদ বাঙালি সমিতির সদস্যরাই একটি জমি কেনেন। হায়দরাবাদ বাঙালি সমিতির একাধিক অনুষ্ঠান সহ করোনাকালে দুবছর সেখানেই পুজো হয়। বর্তমানে তেলেঙ্গানা কালা ভারতী (এনটিআর স্টেডিয়াম) পুজোর আয়োজন করা হয়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জয় কুমার দত্ত জানান, “এই পুজো আক্ষরিক অর্থেই মিলন ক্ষেত্র। ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে এই পুজোতে প্রত্যেকে সামিল হয়ে থাকেন। ভবিষ্যত প্রজন্মকে অখন্ড ভারতের গুরুত্ব বোঝানোই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।’’