নয়াদিল্লি: মন্ত্রিসভায় সংখ্যালঘু সদস্য না থাকায় এ যাবৎ প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এবার দলের জাতীয় স্তরে সংখ্যালঘু সদস্যকে বসাল বিজেপি (BJP)। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি করা হল আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির (Aligarh Muslim University) প্রাক্তন উপাচার্য তারিক মনসুরকে (Tariq Mansoor)। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে (Lok Sabha Elections 2024) সংখ্যালঘুদের কাছে পৌঁছনোর উদ্যোগ শুরু হয়েছে গেরুয়া শিবিরে, বিশেষ করে পসমন্দা মুসলিমদের মনজয়ের বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi)। তারিক সেই পসমন্দা মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য। তাঁকে দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি করে বিজেপি আসলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কাছে টানতে চাইছে বলে মত রাজনৈতিক মহলের।
জাতীয় নাগরিক পঞ্জি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে একসময় বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছিল আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি। সেই সময় পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখেছিলেন তারিক। পরবর্তী কালে বিজেপি-র অভিভাবক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ম সেবক সঙ্ঘের সঙ্গেও কাজ করেছেন। মুঘল যুবরাজ দারা শুকোর হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থান নীতি নিয়ে সঙ্ঘের (RSS) প্রতিনিধি হিসেবে পৌঁছে গিয়েছিলেন পসমন্দা মুসলিমদের কাছে। এবার তাঁকে সহ-সভাপতি করল বিজেপি। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় স্তরে বিজেপি-র সংগঠনে রদবদল ঘটানো হয়েছে। বাংলার বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ এতদিন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি ছিলেন। তাঁর নাম বাদ পড়েছে তালিকা থেকে।
তামিলনাড়ুতে যখন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামকে নিয়ে লেখা বইয়ের উদ্বোধন করছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, তৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই সময়ই তারিকের নাম ঘোষণা করা হয় সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি হিসেবে। পসমন্দা মুসলিমদের কাছে কালাম অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা হল বলে মত রাজনৈতিক মহলের একাংশের। কারণ সংখ্যালঘু মুসলিম, বিশেষ করে পসমন্দা মুসলিমদের কাছে পৌঁছনোর প্রচেষ্টা বেশ কিছু দিন ধরেই দেখ যাচ্ছে বিজেপি-তে। সংখ্যালঘু মোর্চার বৈঠকেও বার বার সেই প্রসঙ্গ উঠেছে।
আরও পড়ুন: Dilip Ghosh: জাতীয় স্তরে BJP-র সংগঠনে বড় ধরনের রদবদল, বাদ পড়লেন দিলীপ, বাংলা থেকে একজনেরই নাম শুধু
উত্তরপ্রদেশ থেকে পসমন্দা মুসলিমদের কাছে পৌঁছনোর উদ্যোগ শুরু বিজেপি-র। মুসলিম সমাজে পসমন্দারা অনগ্রসর শ্রেণি বলেই গন্য হন। উত্তরপ্রদেশে তাঁদের একটি বড় অংশ বিজেপি-কে সমর্থনও করেন। সমাজবাদী পার্টির ভোট কাটতে সেই পসমন্দাদেরই কাছে টানার চেষ্টা শুরু হয় সেখানে। উত্তরপ্রদেশ বিধান পরিষদেও জায়গা দেওয়া হয় মনসুরকে। উত্তরপ্রদেশে আটকে না থেকে, বিহার হয়ে গোটা দেশেই সেই নীতি মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি।
তারিক উত্তরপ্রদেশের আলিগড়েরই বাসিন্দা। সেখানে ভোটার তালিকায় নাম থাকা মুসলিম জনসংখ্যা ১৯ শতাংশ। রাজ্যের অন্তত ৩০টি আসনের মধ্যে ১৫ থেকে ২০টিতে এই পসমন্দাদের ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের সমর্থন হারজিত নির্ধারণ করতে পারে। সেখানে পসমন্দাদের সমর্থন জোগাড়ে তারিক এখনও পর্যন্ত সফলই হয়েছেন। বিশেষ করে দারাশুকো প্রজেক্টে তাঁর ভূমিকা প্রশংসা কুড়িয়েছে সঙ্ঘ নেতৃত্বেরও। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ফার্সি বিভাগ থেকে দারা শুকোর লেখালেখি অনুবাদও করিয়েছেন তারিক, যা পৌঁছে দেওয়া হয় পসমন্দা মুসলিমদের কাছে। দফায় দফায় সেই নিয়ে সভা-সমিতি, সম্মেলনও করেছেন।
শল্য চিকিৎসক তারিক সাতের দশক থেকে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত। জেএন মেডিক্যাল কলেজ থেকে MBBS করেন তিনি। এর পর শল্য চিকিৎসায় MS-ও করেন। বিজেপি-র একটি সূত্রের দাবি, শুধুমাত্র পসমন্দা মুসলিম নয়, শিক্ষিত, অভিজাত মুসলিম, যাঁরা চিকিৎসাক্ষেত্রে, আইনের পেশায় এবং আমলা হিসেবে কর্মরত তাঁদের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সেতুবন্ধনে আগ্রহী বিজেপি এবং সঙ্ঘ। তারিকের পরিবার সেই মাপকাঠিতে সসম্মানে উতরে যায়। কারণ তাঁর পরিবারের প্রায় সব সদস্যই হয় চিকিৎসাক্ষেত্রে যুক্ত থেকেছেন নয়ত বা আইনের পেশায়।
বিজেপি-র সংখ্যালঘু মোর্চার প্রধান জামাল সিদ্দিকির বক্তব্য, "তারিক একজন জাতীয়তাবাদী মুসলিম। দেশকে সবসময় এগিয়ে রেখেছেন তিনি। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঠিক কোথায় সমস্যা রয়েছে, তা বোঝেন তিনি। দেশের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির পড়ুয়াদের সঠিক পথ দেখিয়েছেন, বিভ্রান্ত হতে দেননি। তাঁকে পেয়ে দল আরও উন্নতি করবে।"
তবে তারিককে ঘিরে বিতর্কও কম নেই। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে CAA এবং NRC নিয়ে বিক্ষোভ চলাকালীন, তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পুলিশ যখন ভিতরে ঢুকে পড়ুয়াদের লাঠিপেটা করে, সেই সময় তিনি পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়াননি বলে অভিযোগ। যদিও তারিকের দাবি ছিল, তিনি সবরকম চেষ্টাই করেছিলেন। ব্যক্তি পরিচয়ের থেকে সামাজিক কল্য়াণ এবং আর্থ-সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপই বেশি জোর দিয়েছেন। তাই রীতিমোত ভাবনাচিন্তা করেই তারিককে বিজেপি সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি নিযুক্ত করেছে বলে মত রাজনৈতিক মহলের। যদিও বিরোধী পক্ষ এবং মুসলিম সমাজের বিদ্বজনেদের একাংশের মতে, তারিকের মাধ্যমে সংখ্যালঘু মুসলিমদের মধ্যেও বিভাজন ঘটাতে চাইছে বিজেপি।