নয়াদিল্লি: যুদ্ধাপরাধী বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন কেউ। কেউ আবার আন্তর্জাতিক কূটনীতির 'চাণক্য' বলে সম্বোধন করতেন। সব বিতর্ক পিছনে ফেলে প্রয়াত আমেরিকার প্রাক্তন কূটনীতিক, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী হেনরি কিসিঞ্জার। ১০০ বছর বয়সে বুধবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। কানেটিকটে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন হেনরি। মৃত্যুর আগে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন কিসিঞ্জার। গত মে মাসে শতবর্ষ পূর্ণ করার পরও নিয়মিত হোয়াইট হাউসে আনাগোনা ছিল তাঁর। রাষ্ট্রনেতার ভূমিকা নিয়ে বইও প্রকাশ করেন। এমনকি পরমাণু শক্তি পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া উত্তর কোরিয়া কতটা বিপজ্জনক, তা নিয়ে আমেরিকার সেনেটের শুনানিতেও অংশ নেন। জুলাই মাসে চিন সফরেও গিয়েছিলেন হেনরি। তাঁর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছে চিনও। (Henry Kissinger Demise)
জার্মানিতে জন্ম হেনরির। জার্মানিতে অ্যাডল্ফ হিটলারের শাসন শুরু হলে, হেনস্থার শিকার হয় তাঁর পরিবার। হেনরির বয়স যখন ১৫ বছর, প্রাণে বাঁচতে তাঁর গোটা পরিবার প্রথমে জার্মানি থেকে পালিয়ে ব্রিটেনে আশ্রয় নেয়। তার পর আমেরিকা রওনা দেয়। এর পর আমেরিকার সেনাবাহিনীতে নাম লেখান হেনরি। সেখান থেকেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মান-ভাষী হেনরির কদর বাড়ে আমেরিকার সেনাবাহিনীতে। পদোন্নতি হতে হতে গুপ্তচর সংস্থায় জায়গা পান। (Henry Kissinger Legacy)
বিদেশ সচিব হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি, জন এফ কেনেডি থেকে জো বাইডেন, আমেরিকার ১২ জন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন কিসিঞ্জার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কিসিঞ্জার। সেই সময় আমেরিকার বিদেশনীতির রূপরেখা ঠিক করে দেন তিনিই। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আমলে, আমেরিকার সরকারের দ্বিতীয় শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে ধরা হতো কিসিঞ্জারকে। ঠান্ডাযুদ্ধের সময় আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে টানাপোড়েন যখন চরমে, সেই সময় গোপনে চিনের সঙ্গে রফা শুরু করেন কিসিঞ্জার।
পুঁজিবাদী দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও, চিনের সামরিক, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত উত্থানের সমর্থক ছিলেন কিসিঞ্জার। মাও জে দং থেকে শি চিনপিং, সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর। যে কারণে তাঁর মৃত্যুর খবরে শোকপ্রকাশ করেছে চিন। তাঁকে ‘দীর্ঘদিনের বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেছে। পশ্চিমি দুনিয়ায় চিনকে নিয়ে যে প্রাথমিক ধারণা রয়েছে, তার বিপরীত গিয়ে চিনের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিয়ে বইও লেখেন। যে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলেছিল আমেরিকা, তাদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল হেনরির।
দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনার রূপকার ছিলেন হেনরিই। পরমাণু শক্তি নিরস্ত্রীকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্বাক্ষর করে দুই দেশ। পশ্চিম এশিয়ায় রাশিয়ার আধিপত্য খর্ব হওয়ার নেপথ্যেও ছিলেন হেনরিই। ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে আমেরিকার সরে দাঁড়ানোর নেপথ্যেও তিনিই ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই প্যারিসে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যে কারণে ১৮৭৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। যদিও তাঁর শান্তি পুরস্কার পাওয়া নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
সমালোচকদের মতে, চাইলে অনেক আগেই ভিয়েতনাম যুদ্ধে ইতি টানতে পারতেন হেনরি। কিন্তু আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে বেশি আগ্রহী ছিলেন তিনি। তাই হাজার হাজার মানুষকে যুদ্ধের বলি হতে দেখেও দীর্ঘ সময় নিরুত্তাপ ছিলেন। শুধু তাই নয়, চিলির নির্বাচিত, সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট সালভোদর আলেন্দের সরকার উপরে ফেলার পিছনেও তাঁর হাত ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। ১৯৬৯-’৭০ সালে কম্বোডিয়া বোমা নিক্ষেপ এবং অঘোষিত যু্দ্ধের জন্যও হেনরিকে দায়ী করেন অনেকে, যেখানে ৫০ হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়।
শুধু তাই নয়, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গেও আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক ছিল হেনরির। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দুই পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে, আমেরিকার সেনা পাকিস্তানকে সামরিক শক্তি জোগায়। পাকিস্তান যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশের উপর আক্রমণ, গণহত্যা চালাচ্ছে, সেই সময়ও আমেরিকার সেনা তাদের সহযোগিতা করেছিল। একাধিক দেশ বিষয়টি নিয়ে সরব হওয়ার পরও পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করেননি হেনরি। এমনকি ১০টি বোমারু বিমানও পাকিস্তানের হাতে তুলে দেন তিনি। তার ফলস্বরূপ ৩ লক্ষ মানুষের প্রাণ যায়। ১ কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও ওঠে কিসিঞ্জারের একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়ে।
সেই আবহে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার সঙ্গেও সম্পর্ক তিক্ত হয় কিসিঞ্জারের। ২০০৫ সালে নিক্সনের সঙ্গে কিসিঞ্জারের কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ডিং সামনে আসে। ওই অডিয়ো রেকর্ডিংয়ে ইন্দিরাকে নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় তাঁদের, যেখানে নিক্সন ইন্দিরাকে 'Old Witch' বলে উল্লেখ করেন। হেনরি ইন্দিরাকে 'b***h' বলেন। ভারতীদেয়দের 'জারজ সন্তান' বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ভারতীয় মহিলাদের 'most sexless', 'pathetic' বলেও উল্লেখ করেন নিক্সন।
অডিও রেকর্ডিংটি সামনে আসার পর প্রকাশ্যে ক্ষমা চান হেনরি। বলেন, "৩৫ বছর আগে ঠান্ডা যুদ্ধের আবহে ওই কুকথাকে এখন টেনে আনা অর্থহীন। সেই সময় গোপনে চিন গিয়েছিলাম আমি। নিক্সন তখনও পৌঁছননি। সেই আবহে সোভিয়েত ইউনিয়েনের সঙ্গে হাত মেলায় ভারত। ইন্দিরা গাঁধীকে সম্মান করতাম আমি। ওটা সেই মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া ছিল।" তবে ক্ষমা চাইলেও, ওই অডিও রেকর্ডিং হেনরির কেরিয়ারে কালির ছিটে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। ইন্দিরার দৌলতেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে সেই সময়।। যুদ্ধ মিটলে নিক্সনকে হেনরি বলেছিলেন, অন্তত পশ্চিম পাকিস্তানকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।