পুরী : পুরীর জগন্নাথ মন্দির। ভারতের চার ধাম তীর্থক্ষেত্রগুলির অন্যতম। এখানকার বাৎসরিক রথযাত্রা উৎসবের জগৎজোড়া খ্যাতি। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা শামিল হন। এহেন জগন্নাথ মন্দির ঘিরে রয়েছে একাধিক জনশ্রুতি।
কথিত আছে, ভগবান বিষ্ণুর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পবিত্র মন্দির স্থাপন করেছিলেন রাজা ইন্দ্রদুম। কোনও একদিন নদীতে স্নান করার সময় রাজা দেখতে পান, একটি লোহার রড 'ভাসছে'। ভগবান বিষ্ণু সেই সময় তাঁর কানে-কানে বলেন, লোহার রডটি তাঁর 'হৃদয়'। চমকে ওঠেন রাজা। লোহার রডটি নিয়ে সোজা চলে যান জগন্নাথ মন্দিরে। সেখানেই রেখে দেন। শোনা যায়, তার পর থেকে আর কাউকে কখনও সেই রডটি দেখতে বা স্পর্শ করতে দেননি রাজা।
রয়েছে আরও অনেক জনশ্রুতি। বলা হয়, পাণ্ডবরা যখন যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই সময় সপ্তঋষি 'মোক্ষ' লাভের জন্য তাঁদের 'চার ধাম' পরিদর্শন করতে বলেছিলেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দির চার ধামগুলির মধ্যে অন্যতম। তার পর থেকেই জগন্নাথদেব দর্শনে রয়েছে সীমাবদ্ধতা। নির্দিষ্ট সময়েই মেলে সেই অনুমতি।
জনশ্রুতি তো রয়েছেই। কিন্তু, জানেন কি পুরীর জগন্নাথ মন্দির ঘিরে রয়েছে এমন অনেক রহস্যজনক তথ্য যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মেলেনি(মানুষের বিশ্বাস)। মানুষ বিশ্বাস করেন, এই রহস্যগুলি হচ্ছে প্রভু জগন্নাথের আশীর্বাদ। এগুলি বিশ্বাস করার জন্য আপনাকে পরিদর্শন করতে হবে মন্দির। জেনে নিন সেই তথ্যগুলি...
মন্দিরের চূড়ায় থাকা ধ্বজা :
মন্দিরের চূড়ায় থাকা ধ্বজা অদ্ভুতভাবে সব সময় বাতাসের গতিপথের বিপরীত দিকে উড়তে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এর বৈজ্ঞানিক যুক্তি মেলা কঠিন। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, বিজ্ঞানের থেকেও কিছু ক্ষমতাশালী শক্তি রয়েছে । যার জেরেই এমনটা সম্ভব।
সুদর্শন চক্র :
এই চক্রটি মূলত ২০ ফুট উঁচু এবং এর ওজন এক টন। মন্দিরের চূড়ায় এটি স্থাপন করা আছে। এই চক্রের খুব আকর্ষণীয় একটি বিষয় রয়েছে। সেটি হল, আপনি পুরী শহরের যে কোনও প্রান্ত থেকে এটি দেখতে পাবেন। সেভাবে এই চক্রটি স্থাপনের পিছনে যে ইঞ্জিনিয়ারিং রয়েছে, তা সত্যিই রহস্যেমোড়া। চক্রটি যখনই দেখবেন মনে হবে, সেটি আপনার দিকে তাকিয়ে আছে।
মন্দিরের ওপর দিয়ে যায় না কোনও বিমান, ওড়ে না কোনও পাখি :
আপনি শুনলে অবাক হবেন যে, এই মন্দিরের ওপর দিয়ে যায় না কোনও বিমান, ওড়ে না কোনও পাখি। ভারতের অন্যান্য মন্দিরের ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্য বিরল। জায়গাটি প্রকৃতপক্ষে নো-ফ্লাই জোন। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, কোনও সরকার বা প্রশাসন এই ঘোষণা করেনি। ভক্তদের বিশ্বাস, এর পিছনে রয়েছে দৈবিক বিশ্বাস। এই বিষয়টিও রহস্যে ঘেরা, যার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
মন্দিরের কাঠামো :
এই মন্দিরের কাঠামোটা এমন যে দিনের কোনও সময়ে এর ছায়া দেখা যায় না। এটা সত্যিই বিস্ময়কর। এর পিছনে কোনও ইঞ্জিনিয়ারিং কারুকার্য রয়েছে, নাকি দৈবিক ক্ষমতা- তার ব্যাখ্যা আজও মেলেনি।
সিংহদ্বারের রহস্য :
জগন্নাথ মন্দিরে চারটি দরজা আছে। মন্দিরের মূল প্রবেশপথ সিংহদরজা। যখন সিংহদরজা দিয়ে প্রবেশ করবেন, তখন ঢেউয়ের আওয়াজ শুনতে পাবেন। কিন্তু, একবার সিংহদরজা অতিক্রম করার পর আবার ঘুরে পিছন ফিরে একই দিকে যখন যাবেন, আর ঢেউয়ের আওয়াজ শুনতে পাবেন না। এমনকী যতক্ষণ মন্দিরে আছেন, ততক্ষণ আর ঢেউয়ের আওয়াজ শুনতে পাবেন না।
সমুদ্রের রহস্য :
বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে দেখা যাবে, দিনের বেলায় সমুদ্র থেকে স্থলভাগের দিকে আসছে বাতাস। আর সন্ধেয় স্থলভাগ থেকে সমুদ্রের দিকে বয় বাতাস। কিন্তু, পুরীর ক্ষেত্রে এর বিপরীতটা ঘটে।
১৮০০ বছরের পুরানো প্রথা :
প্রতিদিন একজন পুরোহিত ধ্বজা পাল্টানোর জন্য মন্দিরের চূড়ায় ওঠেন। যা প্রায় ৪৫ তলা বহুতলের সমান। ১৮০০ বছর ধরে এই প্রথা পালিত হচ্ছে। বিশ্বাস রয়েছে, যদি এই প্রথা একবারও বাদ পড়ে, তাহলে পরের ১৮ বছর বন্ধ থাকবে মন্দির।
প্রসাদ-রহস্য :
জগন্নাথ মন্দিরের কোনও কিছুই অপচয় হয় না। রেকর্ড অনুযায়ী, প্রতিদিন ২০০০ থেকে ২০০০০ ভক্ত মন্দির পরিদর্শন করেন(দিন বিশেষে নির্ভর করে বিষয়টি)। কিন্তু, সরাবছর ধরে মন্দিরে একই পরিমাণ প্রসাদ রান্না করা হয়। তা সত্ত্বেও কখনও প্রসাদ নষ্ট হয় না। বা কোনও দিন কম পড়ে না।
প্রসাদ রান্নার প্রক্রিয়া :
কাঠের আগুনে বিশেষ এই প্রসাদ রান্না করা হয়। ব্যবহার করা হয় পাত্র। এজন্য ৭টি পাত্র ব্যবহার করা হয়। একটার ওপর আর একটা রেখে। আকর্ষণীয় বিষয় হল, সবথেকে উপরের পাত্রটি আগে রাঁধা হয়। তারপর একে একে বাকিগুলি।
করোনা আবহে এবারও পালিত হবে পুরীর রথযাত্রা । তবে, করোনা বিধি মেনেই। ১২ জুলাই রয়েছে উৎসব। এছাড়া ২৫ জুলাই পর্যন্ত বন্ধ থাকছে পুরীর মন্দির। ওইদিন পর্যন্ত পুরীর মন্দিরে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ।