ঝিলম করঞ্জাই, কলকাতা: প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে মেরে ফেলা যাচ্ছে না ‘সুপার বাগ’ ব্যাকটেরিয়াদের। ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে সমস্ত সুপার ব্যাকটেরিয়া কিলার অ্যান্টিবায়োটিক!
বছর দশেক আগের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া প্রদেশের সামরিক হাসপাতালে এক রোগীকে পরীক্ষা করার সময়ররা লক্ষ্য করলেন, তার শরীরে এমন মারাত্মক একটি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়েছে, যা প্রচলিত কোনও অ্যান্টিবায়োটিক ডাক্তা দিয়েই সারানো যাচ্ছে না। এমনকী, ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত আমাদের ‘শেষ অস্ত্র’- কলিস্টিন-ও আর কাজ করছে না!
সেই দিনই আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ দফতর ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ জানিয়েছিল, ব্যাকটেরিয়া-প্রতিরোধের লড়াইয়ে, এটা একটা সঙ্কটজনক মুহূর্ত! খুব তাড়াতাড়ি বিকল্প ব্যবস্থার হদিশ না পেলে, এই ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া বা ‘সুপার বাগ’-দের সংক্রমণ ঠেকানোটা কার্যত অসম্ভবই হয়ে পড়বে! এর কয়েকদিন পরেই কলিস্টিনকে রুখে দিতে পারে, এমন আরও একটি ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান মেলে নিউইয়র্কে।
‘সুপার বাগ’দের এই বাড়বাড়ন্ত এরপর থেকেই ঘুম ছুটিয়ে দেয় সারা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের। অধিকাংশ অ্যান্টিবায়োটিককে ভোঁতা করে দিতে পারে, এমন ‘মাল্টিড্রাগ-রেসিস্ট্যান্ট’ বা, ‘MDR' বা 'সুপার বাগ' ব্যাকটেরিয়াদের হদিশ শুধু আমেরিকা নয় ইউরোপ, এশিয়া, কানাডায় এমনকি ভারতেও পাওয়া গিয়েছে।
আর এই বিষয়ে বিপদ সম্পর্কে জনসাধারণ বিশেষত পড়ুয়াদের সচেতন করতে হাত মেলাল কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়াম, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ, ইংল্যান্ডের সায়ন্স মিউজিয়াম গ্রুপ এবং ওয়েলকাম গ্রুপ। সোমবার সায়েন্স সিটিতে এক বিশেষ প্রদর্শনীর গ্যালারির সূচনা করল। চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়ামের ডিরেক্টর জেনারেল অরিজিৎ দত্ত চৌধুরী সহ এক ঝাঁক বিজ্ঞানী ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী।
কেন প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে মেরে ফেলা যাচ্ছে না এই সব ‘সুপার বাগ’ ব্যাকটেরিয়াদের?
বিশেষজ্ঞদের মতে, 'সুপার বাগ' ব্যাকটেরিয়াদের দৌরাত্ম্যে প্রতি বছর ৭ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে!ব্যাকটেরিয়ারা অতি চালাক। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খেলে এ ধরনের বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। আলেকজ়ান্ডার ফ্লেমিং অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পরে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। সতর্ক করে আগাম জানিয়েছিলেন, এমন একটি ওষুধ, যা সাবধানে ব্যবহার না করলে, মানবজাতির সঙ্কট ডেকে আনবে।
অ্যান্টিবায়োটিকদের মধ্যে সবেচেয়ে সেরা যেটি, সেই কার্বাপেনেমের বিরুদ্ধেও এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাকটেরিয়ারা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে ৷
সম্প্রতি ইংল্যান্ডে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র জানিয়েছে, ‘সুপার বাগ’দের রোখার উপায় অবিলম্বে বের করতে না-পারলে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি ৩ সেকেন্ডে ১ জন করে মানুষ ‘সুপার বাগ’-এর সংক্রমণে মারা যাবেন! আর প্রতি বছরে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১৫ গুণ বেড়ে হবে ১ কোটির কাছাকাছি।
বলা ভালো, অনেকেরই একটা ভুল ধারণা আছে, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা, যে কোনও পরজীবীর সংক্রমণ রুখতে গিয়ে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, সেটাই হল- ‘ অ্যান্টিবায়োটিক আদতে শুধুই ব্যাকটেরিয়াদের রুখতে পারে। সীমিত কিছু ক্ষেত্রে প্রোটোজোয়াদের সংক্রমণ রুখতে পারলেও, ভাইরাস বা অন্যান্য পরজীবীকে রুখতে পারে না। অথচ, এ সবের জন্য যথেচ্ছভাবে ব্যবহার হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক।
একই ভাবে, গবাদি পশুর দ্রুত বৃদ্ধির জন্যে তাদের খাদ্যেও প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এ সব থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক রোখার ক্ষমতা ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই কারণেই ব্যাকটেরিয়াদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রায় হঠে যাওয়ার মুখে এই সব ওষুধ!
তাই তাঁদের পরামর্শ, ‘সুপার বাগ’দের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধটা পুরোপুরি জিততে হলে অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। আর সবার প্রথমে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।