নয়াদিল্লি: ২ ,৮৫, ১২০। গণিতের ভাষায়, এগুলি কিছু অঙ্ক মাত্র। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কাছে, পর পর তিনটি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির (BJP Rise On Ram Janmabhoomi Movement) প্রাপ্ত আসনের এই অঙ্ক আসলে ভারতের জাতীয় রাজনীতির ইতিহাসে জল-অচল বিভাজন পর্বের ইঙ্গিত। এর পর থেকেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ভারতীয় মননে আড়াআড়ি ভাগ বসাবে। নয়া এই ধারার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠবে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ,'বীজমন্ত্র' হবে 'হম মন্দির ওয়হি বনায়েঙ্গে।' কিন্তু বহুলশ্রুত এই স্লোগান, যা বিজেপির অন্যতম প্রাণপুরুষ, লালকৃষ্ণ আদবানির হাত ধরে তুমুল জনপ্রিয় হয়, সেই স্লোগানের আদত রচয়িতা কে? আজকের দিনে একবার দেখে নেওয়া যাক।


সত্যনারায়ণ মৌর্য...
আদালতের নির্দেশে তখন সদ্য মন্দিরের তালা খুলে রামলালার অর্চনা শুরু হয়েছে। এই সময়ে রামজন্মভূমি আন্দোলনের রাশ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের হাতে। একই বছর অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে উজ্জয়িনীতে বজরং দল একটি শিবিরের আয়োজন করে। সেই শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন এম.কম পড়ুয়া সত্যনারায়ণ মৌর্য। সন্ধের দিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত ওই শিবিরে। সেই অনুষ্ঠানেই সত্যনারায়ণ মৌর্য স্লোগান দেন,  'রাম লালা হম আয়েঙ্গে, মন্দির ওয়হি বনায়েঙ্গে।' দ্রুত সেই স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে শিবিরের বাকি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যেও। পরে, এই স্লোগানই তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল লালকৃষ্ণ আদবানির হাত ধরে। কী ভাবে? 


ইতিহাস...
১৯৮৪ সালের লোকসভা ভোট। ইন্দিরা গাঁধী হত্যার দু'মাসের মাথায় দাপুটে জয় পেয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরল কংগ্রেস। তাদের প্রাপ্ত ৪০৪ আসনের পাশে কার্যত দেখাই যায়নি ২টি আসনে জয়ী বিজেপিকে। কিন্তু বিজেপির তৎকালীন সভাপতি লালকৃষ্ণ আদবানি স্থির করেছিলেন,দলের মতাদর্শ হিসেবে কট্টর হিন্দুত্বের প্রচার থেকে সরবেন না। বরং এই আদর্শেই শান দেবেন। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। 'ভুয়ো ধর্মনিরপেক্ষতা', 'মুসলিম তোষণ'-র মতো একাধিক প্রচারমন্ত্রে জোর দিল আদবানির বিজেপি। ধার্ত্রী সংগঠন, আরএসএসের মতাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এই ভাবনাচিন্তা যে সে সময় বিজেপিকে তুমুল ডিভিডেন্ড' দিয়েছিল, সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় ১৯৮৯ সালের লোকসভা ভোটে। পাঁচ বছরের মধ্যে, লোকসভা ভোটে বিজেপির প্রাপ্ত আসনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫। একথা সত্যি যে, এই মাঝের পাঁচ বছরে,বফর্স-কেলেঙ্কারি,শাহ বানো মামলা, অযোধ্যার মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া ইত্যাদি নানা কারণে জমি হারাতে হয়েছিল রাজীব গাঁধীর সরকারকে। তবে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের রমরমাও যে কংগ্রেসের কপালে ঘাম ছুটিয়েছিল, সে কথাও স্পষ্ট। 


রথযাত্রা...
১৯৯১ সালের লোকসভা ভোটের আগে আদবানির 'রথযাত্রা'এই মতাদর্শের জনপ্রিয়তায় ভরপুর অক্সিজেন জোগায়। এই সময়ই বাবরি মসজিদের জমিতে রামমন্দির নির্মাণের বিষয়টি বেশি করে উঠে আসতে থাকে বিজেপির অন্যতম প্রাণপুরুষের কথায়। একের পর এক জনসভায়,আদবানিকে বলতে শোনা যায়, 'সওগন্ধ রাম কি খাত-এ হ্যায়, হম মন্দির ওয়হি বনায়েঙ্গে।' সামনে বসে থাকা দর্শকদের হাততালিতে কান পাতা দায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে যে স্পষ্ট বিভাজনের ধারা তৈরি হচ্ছিল, তারই শব্দ ধরা পড়ে সমর্থনের আওয়াজে। ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখা যায়, বিজেপির আসনসংখ্যা পৌঁছে গিয়েছে ১২০-তে। মাত্র ৭ বছর আগে ভোটের রাজনীতিতে নগণ্য একটি দল এই পথেই রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় শতাব্দীপ্রাচীন দলের।
এর পর 'বাবরি মসজিদ'-র ধ্বংসের পর্ব দেখেছে এ দেশ। সাক্ষী থেকেছে তুমুল অশান্তির। এই প্রসঙ্গে আজও অনেকে মনে করেন, উমা ভারতীর প্রিয় স্লোগানের কথা। 'এক ধাক্কা অওর দো, বাবরি মসজিদ  তোড় দো'জাতীয় স্লোগানের জন্য বার বার সমালোচনার মুখে পড়েছেন আদবানির অনুগামী বলে পরিচিত এই বিজেপি নেত্রী। যদিও আদবানি স্বয়ং সরাসরি এই স্লোগানের সমর্থন করতেন না। বরং বার্তা দিতেন, হিন্দুরা ভাঙা নয়, গড়ায়, একসঙ্গে থাকায় বিশ্বাসী। কিন্তু রামমন্দির নিয়ে নিজের অবস্থানে যে তিনি অনড়, সেটাও বার বার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা। ১৯৯১ সালের ভোটের আগে  জনসভায় তাঁকে বলতে শোনা যেত, 'ইসলাম ধর্মগ্রন্থই বলে, যেখানে আজান হয় না, সেটিকে মসজিদ বলা যায় না।...এই জায়গাটির উপর দাবিদাওয়া ছেড়ে দেওয়া উচিত মুসলিমদের।' সরাসরি ধ্বংসাত্মক স্লোগানের কথা না বলেও হিন্দু ভাবাবেগকে একত্র করার জন্য যত রকম চেষ্টা ছিল, তার সবটাই করেন বিজেপির এই প্রাণপুরুষ।
১৯৯০ সালে তাঁর রথযাত্রা থমকে যায় বিহারে। লালুপ্রসাদ যাদবের প্রশাসনের হাতে গ্রেফতার হন লালকৃষ্ণ আদবানি। কিন্তু রামমন্দি নির্মাণের লক্ষ্যে অনড় ছিলেন তিনি। বিতর্কিত জমিতে মন্দির তৈরির প্রশ্নেও আপস করেননি। সেই মন্দিরে আজ প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল রামলালার। কিন্তু বীজমন্ত্র দিয়েছিলেন যিনি, সেই আদবানি কোথায়? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।


 


(তথ্যসূত্র:www.abplive.com)


আরও পড়ুন:রামমন্দির নিয়ে অনুষ্ঠানে হাজির BJP সাংসদ, তাড়ালেন গ্রামবাসীরা