নয়াদিল্লি: 'এক দেশ, এক নির্বাচন' নীতি কার্যকর করা নিয়ে বিতর্ক চলছেই। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের (Lok Sabha Elections 2024) আগে এবার দেশের নাম ঘিরে বিতর্ক। ইংরেজিতে 'India'র পরিবর্তে সব ভাষায় দেশের নাম 'ভারত' রাখার দাবি উঠতে শুরু করেছে। বিজেপি-র নেতা-মন্ত্রীরা সেই মর্মে সংবিধান সংশোধনের দাবি তুলছেন (India Name Change)। রাষ্ট্রপতির চিঠিতেও ইতিমধ্যেই 'India'র পরিবর্তে 'ভারত' লেখা হয়েছে। এর তীব্র বিরোধিতা করছেন বিরোধীরা। কিন্তু দেশের নাম নিয়ে কী বলছে সংবিধান? সুপ্রিম কোর্টেরই বা কী মত? জানুন বিশদ।  (India or Bharat)


দেশের নাম নিয়ে কী বলছে সংবিধান?


দেশের নাম হিসেবে 'India' এবং 'ভারত' দুইয়েরই উল্লেখ রয়েছে। দেশের সংবিধানের ১ নং অনুচ্ছেদে লেখা রয়েছে, 'ইন্ডিয়া, অর্থাৎ ভারত, রাজ্যের সমষ্টি'।  অর্থাৎ 'India' এবং 'ভারত', দুই নামেই সাংবিধানিক সিলমোহর রয়েছে। প্রয়োজন এবং সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করা যেতে পারে দুই নামই। তাই দেশের নাম শুধুমাত্র 'ভারত' করতে গেলে, সংবিধানে সংশোধন ঘটাতে হবে। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার সংসদে সেই মর্মে বিলও আনতে চলেছে বলে শোনা যাচ্ছে। তাদের এই চেষ্টারই বিরোধিতা করছেন বিরোধীরা। 


সুপ্রিম কোর্ট কী বলছে?


'India'র পরিবর্তে সব ভাষায় দেশের নাম 'ভারত' রাখার দাবি আজকের নয়। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টেও পৌঁছয়। ২০১৬ সালে দায়ের হয় জনস্বার্থ মামলা, যার আওতায় দেশের নাম পাল্টানোর আবেদন জানানো হয়। কিন্তু সেই সময়, সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি টিএস ঠাকুর এবং বিচারপতি ইউইউ ললিত সেই আবেদন খারিজ করে দেন। এই ধরনের আবেদন অর্থহীন বলে মন্তব্য করেছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। 


২০১৬ সালের মার্চ মাসের ওই আবেদনের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট বলে, "ভারত না ইন্ডিয়া? ভারত বলতে চাইলে ভারত বলুন। কেউ যদি India ব্যবহার করতে চান, তাঁদের India ব্যবহার করতে পারেন।" এর পর ২০২০ সালেও ফের একটি আবেদন জমা পড়ে। দেশের নাম বদলে শুধুমাত্র 'ভারত' রাখার আবেদন জানানো হয় আরও একবার।


আরও পড়ুন: G20 Summit 2023: দেশের নামও পরিবর্তন, 'INDIA' নয়, লিখতে হবে শুধু 'ভারত'! রাষ্ট্রপতির চিঠি ঘিরে বিতর্ক


সেই সময় ওই আবেদনকে জনগণের নিবেদন হিসেবে কেন্দ্রের কাছে পাঠানোর প্রস্তাব দেয় সর্বোচ্চ আদালত। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসএ বোবডে বলেন, "সংবিধানে ভারত এবং India, দুই নামেরই উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানে দেশকে ভারত বলা হয়েছে, আবার India-ও বলা হয়েছে।"


নাম পরিবর্তনের নেপথ্যে রাজনৈতিক কৌশল!


কিন্তু এবার আর আবেদন বা নিবেদন নয়, সরাসরি দেশের নাম 'India'র পরিবর্তে 'ভারত' করার প্রচেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ। কারণ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু স্বাক্ষরিত জি-২০ সম্মেলনের নিমন্ত্রণপত্রে ইতিমধ্যেই দেশের নাম হিসেবে 'ভারতে'র উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে যে পুস্তিকা পাঠানো হয়েছে, তাতেও একই পন্থা অবলম্বন করেছেন রাষ্ট্রপতি। 


অতি সম্প্রতি বিজেপি বিরোধী জোটের নামকরণ হয়েছে I.N.D.I.A, দেশের অনুকরণেই। সেই নিয়ে আগাগোড়া বিরোধী জোটকে আক্রমণ করে আসছে বিজেপি এবং কেন্দ্রে তাদের সরকার। বিরোধীদের সঙ্গে সরাসরি মুজাহিদিন, PFI-এর মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের তুলনা টেনেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাই শুধুমাত্র নামের জোরেই যাতে বিরোধীরা লোকসভা নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা না পেয়ে যায়, তার জন্যই দেশের নাম পাল্টানোর এই উদ্যোগ বলে অভিযোগ করছেন বিরোধীরা। 


সংবিধান সংশোধন করবে কেন্দ্র?


চলতি মাসে সংসদে পাঁচদিনের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। দেশের নাম পরিবর্তনে সেখানে বিল আনা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিজেপি-র নেতা-মন্ত্রীরা তার সপক্ষে প্রচারও শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু দেশের নাম পাল্টাতে গেলে সবার আগে সংবিধানে সংশোধন ঘটাতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রথমে সংবিধানের ১ নং অনুচ্ছেদটিকে সংশোধনের বিল আনতে হবে সংসদে।


সংবিধানের ৩৬৮ নং ধারায় সংসদে ভোটাভুটির মাধ্যমে সংবিধানে সংশোধন ঘটানোর অনুমোদন রয়েছে। নতুন রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি, রাজ্যসভার আসনসংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের সমর্থন থাকলেই এই সংক্রান্ত সংশোধন ঘটানো যেতে পারে। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ১ নং অনুচ্ছেদে সংশোধন ঘটাতে হলে, বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন পড়বে, অর্থাৎ ভোটাভুটিতে উপস্থিত ৬৬ শতাংশের সমর্থন লাগবে কেন্দ্রের। 


এক দেশ, বহু নাম, উদাহরণ কম নেই


তবে কোনও দেশের একটিই নাম হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই বিশ্বের কোথাওই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইংরেজিতে জাপান বলা হলেও, দেশের ভাষা অনুযায়ী জাপানের নাম নিহঁ, কেউ কেউ আবার নিপ্পঁও বলেন। ইংরেজিতে জার্মানি লেখে হলেও, ডয়েচল্যান্ড, নেমশি, থেকে সাকসা, একাধিক দেশে একাধিক নামে পরিচিত জার্মানি। একই ভাবে নেদারল্যান্ডস পরিটিত হল্যান্ড নামেও। ইংরেজিতে চিনকে China লেখা হলেও, স্থানীয়রা চিন-ই বলেন। এ ছাড়াও চিনকে কিনা, সিনোও বলা হয়। ম্যান্ডারিনে চিনের নাম ঝোঙ্গুও। উত্তর কোরিয়াকে জোসন, দক্ষিণ কোরিয়াকে হাংগুকও বলা হয়। ইংরেজিতে ফিনল্যান্ড বলা হলেও, স্থানীয় ভাষায় দেশের নাম সুওমি। এমন আরও অনেক দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।


একই ভাবে ভারতও বহুভাষী দেশ। কয়েক শো কিলোমিটার অন্তরই ভাষার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এমন দেশের একাধিক নাম হওয়ার মধ্যে সমস্যার কিছু নেই বলে মত বিশেষজ্ঞদের। বরং কোনও একটি নাম জোর করে চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয় বলে মত তাঁদের। আম আদমি পার্টির সাংসদ রাঘব চাড্ডা সেই বক্তব্যই তুলে ধরেছেন। তাঁর কথায়, ১৪০ কোটি মানুষ কী পরিচয়ে পরিচিত হবেন, তা কোনও একটি দল ঠিক করে দিতে পারে না।