নয়াদিল্লি: স্বাধীনতা সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব। দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। কিন্তু বর্তমানে অস্তিত্বসঙ্কটে ভুগছে। সেই পরিস্থিতি থেকে দলকে বার করে আনতে উদ্যোগী কংগ্রেস নেতৃত্ব (Congress Presidential Election)। দীর্ঘ টানাপোড়েনর পর সভাপতি নির্বাচন করতে চলেছেন। তাতে গাঁধী পরিবারের (Gandhi Family) কোনও সদস্য নেই। বরং মুখোমুখি লড়াইয়ে নামছেন শশী তারুর এবং মল্লিকার্জুন খড়্গে। প্রায় আড়াই দশক পর এই প্রথম সভাপতি হওয়ার দৌড়ে নেই গাঁধী পরিবারের কোনও সদস্য।
প্রায় আড়াই দশক পর কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে নেই গাঁধী পরিবারের কেউ
তাই এ বারের কংগ্রেস নির্বাচনের উপর নির্ভর করছে অনেক কিছুই। আর তাতেই বার বার উঠে আসছে ১৩৭ বছর পুরনো কংগ্রেসের এ যাবৎকালীন সভাপতি নির্বাচনের খতিয়ান,৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যার নেতৃত্ব রয়েছে নেহরু-গাঁধী পরিবারের সদস্যদের হাতে। মোতিলাল নেহরু থেকে সনিয়া গাঁধী, দীর্ঘ সময় গাঁধী পরিবারের হাতেই দলের রাশ থাকলেও, মাঝে পিভি নরসিংহ রাও, সীতারাম কেশরীও নেতৃত্ব দিয়েছেন গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টিকে। আসন্ন কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনের আগে তাই ফিরে দেখা রাজনীতিতে কংগ্রেসের নেতৃত্ববদলের ইতিহাস।
মোতিলাল নেহরু
১৯১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির (AICC) ৩৪তম অধিবেশন বসে। সেখানে মহাত্মা গাঁধী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতৃত্বের উপস্থিতিতে সভাপতি নির্বাচিত হন মোতিলাল নেহরু। সেই সময় মোতিলালের বয়স ছিল ৬০ বছর। পশ্চিমি আদবকায়দায় অভ্যস্ত মোতিলালকে সভাপতি করায় অনীহা ছিল অনেকেরই। এমনকি ইংরেজ শাসকের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে আইনভঙ্গের বিরোধী ছিলেন খোদ মোতিলালও। কিন্তু ১৯১৯ সালের এপ্রিলে ঘটে যাওয়া জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড বদলে দেয় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি।
জওহরলাল নেহরু
ইরাবতী নদীর তীরে লহৌর অধিবেশনে ১৯২৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন ৪০ বছরের জওহরলাল নেহরু। সভাপতি পদ গ্রহণে খুব একটা সায় ছিল না তাঁর। কিন্তু মহাত্মা গাঁধী তাঁর নাম প্রস্তাব করেন। তাতে সমর্থন জানান মোতিলালও। বাবা হয়ে তিনি যা করতে পারেননি, ছেলে করে দেখাবেন বলে আত্মবিশ্বাসও প্রকাশ করেন। সভাপতি নেহরুকে ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে যান কর্মী-সমর্থকেরা। ১২ বছরের ইন্দিরা গাঁধী, মোতিলাল এবং স্বরূপ রানি সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
ইন্দিরা গাঁধী
বাবা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনই ১৯৫৯ সালে এক বছরের জন্য কংগ্রেসের সভাপতি হন ইন্দিরা গাঁধী। মেয়েকে রাজনীতিতে এগিয়ে দিতে জওহরলালই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে সেই সময় মনে করেছিলেন অনেকে। কিন্তু কংগ্রেসের অন্দরে সকলেই জানতেন, মেয়েকে রাজনীতিতে ঠেলতে চাননি জওহরলাল। কিন্তু কংগ্রেসিদের মতে, নেহরু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন পারস্পরিক সহাবস্থানে। তাই কেরলে নাম্বুদিরিপাদের বাম সরকারে হস্তক্ষেপ করতে চাননি। ইন্দিরাকে এনে সেই কার্যসিদ্ধি করেন কংগ্রেসেরই একাংশ। ১৯৬০ সালে কংগ্রেস সভাপতি পদে মেয়াদ শেষ হয় ইন্দিরার। জওহরলালের মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে ফের সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরেন।
রাজীব গাঁধী
ইন্দিরা গাঁধী খুন হলে দিল্লিতে শিখবিরোধী দাঙ্গা বেধে যায়। সেই অবস্থায় ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন রাজীব গাঁধী। সে বছর ৩১ অক্টোবর কমগ্রেস নেতা কমলাপতি ত্রিপাঠী রাজীবের নাম প্রস্তাব করেন সভাপতি পদে। ২৮ ডিসেম্বর জানা যায়, রাজীবই কংগ্রেসের সভাপতি।
পিভি নরসিংহ রাও
১৯৯১ সালের ২১ মে খুন হন রাজীব গাঁধী। সেই সময় রাজনীতিতে অনাগ্রহী ছিলেন সনিয়া গাঁধী। দলের রাশ হাতে তুলে দেওয়ার মতো গাঁধী পরিবারে কেউ ছিলেন না। তাতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ১২ জন সদস্য বৈঠকে বসেন। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্তেই উপনীত হওয়া যায়নি। এর পর প্রণব মুখোপাধ্যায় পিভি নরসিংহের নাম প্রস্তাব করেন। ততদিনে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছেন নরসিংহ। অর্জুন সিংহ আবার সনিয়ার নাম প্রস্তাব করেন। তখনও রাজীবের দেহের সৎকার হয়নি। ১০ মিনিটও কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে কথা বলেননি সনিয়া। স্বামীর দেহ পড়ে থাকতেই তাঁর উত্তরাধিকার খোঁজার এই উদ্যোগে অসন্তুষ্ট হন সনিয়া। পর দিন বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়ে দেন, তিনি পদগ্রহণ করবেন না। এর পর ১৯৯১ সালের ২৩ মে কংগ্রেস সভাপতি নিযুক্ত হন নরসিংহ।
সীতারাম কেশরী
নরসিংহের প্রস্থানে সীতারাম কেশরীর গুরুত্ব বাড়ে কংগ্রেসে। কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষও ছিলেন তিনি। রাজীব গাঁধীর সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক ছিল তাঁর। ১৯৯৬ সালে শরদ পওয়ার এবং রাজেশ পায়লটকে হারিয়ে বিজয়ী হন সীতারাম। যদিও নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠে।
সনিয়া গাঁধী
কংগ্রেস সভাপতি পদ থেকে আচমকা সীতারাম কেশরীর প্রস্থানে হতবাক হয়ে যায় রাজনৈতিক মহল। ১৯৯৮ সালের ১৪ মার্চ কার্যতই কংগ্রেসের অন্দরে অভ্যুত্থান ঘটে। সীতারাম কেশরী কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পৌঁছনোর আগেই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে একত্রিত হন কংগ্রেস নেতারা। সীতারামকে সরিয়ে সনিয়াকে দায়িত্বে বসানোর দাবি তোলেন তাঁরা। সীতারাম কেশরী এসে পৌঁছনোর আগেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যায়, যা পড়ে শোনান প্রণব। রাগে, ক্ষোভে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সীতারাম কেশরী দেখেন, দরজার উপর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে তাঁর নেমপ্লেট। তার জায়গায় সনিয়ার নামের প্রিন্টআউট ঝুলছে। যুব কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে হাতাহাতিতেও জড়িয়ে পড়েন তিনি।
রাহুল গাঁধী
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রাহুল গাঁধীকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা শুরু হয়। ২০১৭-র ১৬ ডিসেম্বর কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন রাহুল। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে শোচনীয় হারের পর দায় স্বীকার করে পদ ছাড়েন তিনি। ২০১৯ সালের ২৫ মে পদত্যাগ করেন রাহুল, যা গৃহীত হয় ৩ জুলাই।
সনিয়া গাঁধী (প্রত্যাবর্তন)
রাহুল পদত্যাগ করায় হইচটই পড়ে যায় দলে। তাঁকে সিদ্ধান্ত বদল করতে চাপ দিতে থাকেন অনেকেই। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন রাহুল। এৎ পর ৯ এবং ১০ অগাস্ট দলের নেতারা একত্রিত হন। সর্বসম্মতিতে সনিয়ার হাতেই দায়িত্ব তুলে দেওয়ায় একমত হন সকলে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন সনিয়া। এক বছরের মধ্যে যোগ্যতনকে বেছে সভাপতি নির্বাচন হবে বলে ঠিক হয়। কিন্তু করোনার জেরে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এখনও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সনিয়াই।