পাটনা: লম্বা লাইনে পাশাপাশি বসে ভোগের খিচুড়ি খাওয়ার মতোই অভিজ্ঞতা। তবে কয়েকশো ছেলেমেয়েকে রোজ রোজ খিচুড়ি খাওয়ানোর সাধ্য নেই পকেটের। তবে অকাতরে বিলোলেও যা ফুরোয় না, সেই শিক্ষাই সবার পাতে উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছেন মাস্টারমশাই। উপরি কিছুর প্রত্যাশা না রেখে চেটেপুটে তা গ্রহণও করছেন সকলে। তির তির করে বয়ে চলা গঙ্গার ঘাটের (Ganga Ghat) এই দৃশ্যে এখন চোখ সয়ে গিয়েছে পাটনাবাসীরও (Patna News)।
শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, বিহারের (Bihar News) পাটনার গঙ্গার ঘাটে বেশ কিছুদিন ধরেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সমাগম ঘটে চলেছে পড়ুয়াদের। ঘাটের সিঁড়ির ধাপ থেকে জলের উপর প্ল্যাটফর্মের আকারে মাথা তুলে জেগে থাকা অংশ একরকম ঠাসাঠাসি করেই বসা। তার পর মেঝের উপর ঝুঁকে অথবা কোলের উপর পেতে রাখা সাদা পাতায় মুখ গুঁজে একটানা লিখে যাওয়া। গত দু’মাস ধরে সপ্তাহে দু’দিন এমনটাই চলে আসছে সেখানে।
জীবন গুছিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে ওরা
গঙ্গার ঘাটে পড়ুয়াদের এই সমাগমের নেপথ্যে রয়েছেন এসকে ঝা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন নিজে। রোজগার যা করেন, তা দিয়ে সমাজসেবা চলে না। তাই নিজের অর্জিত শিক্ষাই অকাতরে বিলিয়ে চলেছেন তিনি। আর শুধু নিজে নন, সমমনস্ক জনা তিরিশের একটি দলও জুটিয়ে ফেলেছেন। সকলে মিলে গঙ্গার ঘাটেই খুলে বসেছেন পাঠশালা।
অনলাইন শিক্ষার যুগে সেই পাঠশালায় ভিড়ও করছেন শয়ে শয়ে ছেলেমেয়ে। শুধু পাটনা বা বিহার নয়, সীমান্ত লাগোয়া উত্তরপ্রদেশ তো বটেই, রাজস্থান থেকেও সেই পাঠশালায় নাম লিখিয়েছেন অনেকে। ক্লাস শুরু হয় একটু বেলা করে, ৬টা নাগাদ। কিন্তু ভোর ৪টেতেও পৌঁছে যান অনেকে। গোল হয়ে বসে চলে গ্রুপ স্টাডি। স্কুল বা কলেজের পড়াশোনা নয়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় (Competitive Exams) পাশ করে চাকরি জোটানোর পড়াশোনা। পরস্পরকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার তাগিদ।
তাই নিজেকে শ্রেয় দিতে নারাজ ‘মাস্টারমশাই’। বরং দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা ছেলেমেয়েদেরই এই পাঠশালার কৃতিত্ব দিচ্ছেন তিনি। জানিয়েছেন, ক্লাস করতে যাঁরা আসেন, অধিকাংশই হয় রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ড (RRB) অথবা স্টাফ সিলেকশন কমিশন (SSC) চাকরি প্রার্থী। নন টেকনিক্যাল পপুলার ক্যাটেগরি (NTPC) পরীক্ষায় প্রথম ধাপ উতরে গিয়েছেন। পরের ধাপের পরীক্ষার কোনও হাল-হদিশ নেই। তাই বলে প্রস্তুতিতেও ফাঁক রাখা যায় না। কিন্তু পয়সা খরচ করে কোচিং নেওয়ার সাধ্য নেই কারও। তাই দূরে হলেও, বিনে পয়সার পাঠশালাতেই ভিড় করেন সকলে।
দূর-দূরান্ত থেকে আসা পড়ুয়াদের ভিড়
‘মাস্টারমশাই’ জানিয়েছেন, শনি-রবি, সপ্তাহে এই দু’দিন পাঠশালা চালান তিনি। ৩০-৩৫ জনের একটি দল রয়েছে। সপ্তাহভর পরিশ্রম করে প্রশ্নপত্র তৈরি করেন তাঁরা। ৯০ মিনিটের পরীক্ষা। ১২০টি প্রশ্ন। তা লিখতেই সপ্তাহে দু’দিন ১২০০-১৪০০ ছেলেমেয়ে ভিড় করেন। তাতে পরীক্ষার প্রস্তুতিও যেমন সারা হয়, আবার কোথাও আটকে গেলে জেনে নেওয়া হয় সমাধানও। চাকরি না পাওয়ার হতাশা কাটিয়ে, আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতেও পাঠশালা কামাই করেন না অনেকে।
নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ ঘিরে কয়েক মাস আগে এই বিহারেই আগুন জ্বলে উঠেছিল। চাকরি না পাওয়ার হতাশা ছাইচাপা আগুন হয়ে ধরা দেয়,তাতে ভস্মীভূত হয়ে যায় গোটা একটি ট্রেন। সেই ছাত্ররোষকে সন্ত্রাসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন কেউ কেউ। ছত্রভঙ্গ করতে চালানো হয়েছিল গুলিও। নিত্য ভূরি ভূরি খবরের ঠেলায় সেই বিক্ষোভকারীদের হাল-হাকিকত ঢাকা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু লড়াই চলছেই। স্থান-কালই যা বদলেছে একটু। গঙ্গাপাড়ের পাঠশালাই স্বপ্ন দেখার ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন: Punjab News: বিনামূল্যে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ, মসনদে একমাস পূর্ণ হতেই ঘোষণা পঞ্জাব সরকারের