কলকাতা: আধুনিক যুদ্ধে যে কোনও দেশের বড় হাতিয়ার হচ্ছে তার মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার ও বৈচিত্র্য। ভারতের মতো দেশ, যার দুদিকে দুই প্রবল প্রতিপক্ষ রয়েছে-- এমন একটি দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্ষেপণাস্ত্র অতি-গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। 


১৯৮৩ সালে দেশের প্রতিরক্ষার জন্য দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (আইজিএমডিপি)-র যাত্রা। ওই তালিকায় ছিল অগ্নি, পৃথ্বী, নাগ, আকাশ ও ত্রিশূল -- এই পাঁচ ক্ষেপণাস্ত্র। 


সেই থেকে আজকের দিন অনেকটা পথ অতিক্রম করেছে ভারত। এখন ভারতে হাতের এমন ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা প্রতিপক্ষরা ঈর্ষা করে। এমন ক্ষেপণাস্ত্র, যা আমেরিকা বা চিন-- কারও নেই।


ভারতের ক্ষেপণাস্ত্রের তালিকা নেহাৎ কম নয়। নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ থেকে শুরু করে বিদেশ থেকে সরাসরি আমদানি-- ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার বিশ্বের সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে।


ভারতের হাতে এখন কী কী ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, তা জানার আগে, এটা জেনে রাখা জরুরি, ভারতের হাতে থাকা ক্ষেপণাস্ত্রগুলি কোন কোন শ্রেণিভুক্ত। অর্থাৎ, কী কী ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের কাছে রয়েছে। 


আগামী রবিবার দেশজুড়ে পালিত হতে চলেছে ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবস। তার আগে, দেখে নেওয়া যাক ভারতের মিসাইল সম্ভার--



  • ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র (SAM)

  • আকাশ থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র (AAM)

  • ভূমি থেকে ভূমি ক্ষেপণাস্ত্র (SSM)

  • আকাশ থেকে ভূমি ক্ষেপণাস্ত্র (ASM)

  • ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী/ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র (BMD)

  • ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র

  • সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র (SLBM)

  • ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র (ATGM)


এছাড়া, সম্প্রতি ভারত আরও নতুন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হল --



  • স্যাটেলাইট-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র (ASAT)

  • অ্যান্টি-রেডিয়েশন ক্ষেপণাস্ত্র (ARM)


 


ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র (SAM) -


এই ক্ষেপণাস্ত্রের উদ্দেশ্য হল শত্রুপক্ষের বিমান বা ড্রোনকে ধ্বংস করা। অর্থাৎ, দেশের আকাশসীমাকে সুরক্ষিত রাখা। 


এক্ষেত্রে ভারতে হাতে রয়েছে AKASH Mark-I ক্ষেপণাস্ত্র। মাঝারি পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্রের দুটি ভিন্ন সংস্করণ ভারতীয় স্থলসেনা ও বায়ুসেনার জন্য় তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে, এর অপর দুটি ভেরিয়েন্ট (AKASH Mark-II ও AKASH-NG) নিয়ে এখন গবেষণা ও পরীক্ষার কাজ চলছে। 


পরীক্ষায় উতরোতে না পারার জন্য ২০০৮ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয় ত্রিশূল ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পটি। এটি মূলত আকাশপথে হামলা থেকে জাহাজকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হচ্ছিল। পরিবর্তে, ইজরায়েল থেকে BARAK-8 মিসাইল সিস্টেম আমদানি করে ভারত। দুধরনের জাহাজ থেকে নিক্ষেপযোগ্য বরাক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে ভারতের। একটি মাঝারি পাল্লার ও একটি দূরপাল্লার। বরাকের বিশেষত্ব হল, এটি ভূমিতেও আঘাত হানতে সক্ষম।


সম্প্রতি, ভারত নিজস্ব প্রযুক্তিতে এই শ্রেণির অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র QRSAM নিয়ে পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ চালিয়েছে। এর পাশাপাশি, গবেষণা চলছে XRSAM ও PRADYUMNA ক্ষেপণাস্ত্র নিয়েও। তবে, এক্ষেত্রে ভারতের আগামীদিনের বড় ভরসা হতে চলেছে রাশিয়া থেকে কেনা S-400 দূরপাল্লার বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী SAM সিস্টেম। সূত্রের খবর, চলতি বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ভারতের হাতে আসতে চলছে এস-৪০০ 'ট্রায়াম্ফ' সিস্টেমের প্রথম ব্যাচ।



ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী/ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র (BMD) -


ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করে দেশের ব্যালিস্টিক মিসাইস ডিফেন্স (BMD)। দেশের আকাশসীমায় শত্রুদেশের কোনও বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন ঢোকার সম্ভাবনা দেখা দিলেই, এই সিস্টেম চালু হয়ে যায়। মাঝ-আকাশেই লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে সক্ষম এই ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা। 


বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে ওপরের স্তরে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রকে ইন্টারসেপ্ট করে ধ্বংস করতে ভারতের হাতে রয়েছে পৃথ্বী ডিফেন্স ভেহিকল (PDV)। এটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ১২০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত গিয়ে কোনও মিসাইল ধ্বংস করতে পারে। এর ঠিক নীচের স্তরে রয়েছে পৃথ্বী এয়ার ডিফেন্স (PAD)। এটি ৮০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত যেতে পারে। একেবারে শেষস্তরে রয়েছে অ্যাডভান্সড এয়ার ডিফেন্স (AAD)। এটি মাটি থেকে ৩০ কিমি ওপর পর্যন্ত যে কোনও শত্রু-টার্গেট ধ্বংস করতে পারে। এটি হাওয়ার গতির তুলনায় ৪.৫ গুণ দ্রুত যেতে পারে।


 


আকাশ থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র (AAM) -


মাঝ-আকাশে ডগফাইট, অর্থাৎ, মাঝ-আকাশে দুই বিমানের যুদ্ধ, অথবা বিমান থেকে শত্রুর বিমান/ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 


এই শ্রেণিতে ভারতের হাতে সর্বশেষ সংযোজিত ক্ষেপণাস্ত্রটি সারা বিশ্বে বিখ্যাত। বলা যেতে পারে, বর্তমানে, এটিই এই মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর আকাশ থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র। নাম METEOR। ফ্রান্স থেকে কেনা রাফাল যুদ্ধবিমান এই ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত। এটি বিয়ন্ড ভিজ্যুয়াল রেঞ্জ (BVR) ক্ষেপণাস্ত্র। অর্থাৎ, শত্রুর আকাশসীমায় না প্রবেশ করে, এই ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে তাদের বিমানকে ধ্বংস করতে পারবে ভারতীয় বায়ুসেনা।


এর পাশাপাশি, ভারতের হাতে রয়েছে MICA, PYTHON-5, NOVATOR-K100 ও ASTRA-এর মতে আকাশ থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে নোভাটর-কে১০০ হল অ্যাওয়াক্স (AWACS) বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। মিটিওর-এর মতো BVR ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্র মার্ক-১ সংস্করণ বাহিনীতে ব্যবহার হচ্ছে। এর মার্ক-২ ও মার্ক-৩ সংস্করণ নিয়ে পরীক্ষা চলছে।



ভূমি থেকে ভূমি ক্ষেপণাস্ত্র (SSM) -


এই শ্রেণির তালিকা সবচেয়ে দীর্ঘ। এই শ্রেণিতে রয়েছে PRITHVI সিরিজ (পৃথ্বী-১, পৃধ্বী-২ ও পৃথ্বী-৩)। AGNI সিরিজ (অগ্নি-১, অগ্নি-২, অগ্নি-৩, অগ্নি-৪ ও অগ্নি-৫)। সম্প্রতি, অগ্নি-প্রাইম ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয়েছে। গবেষণা চলছে অগ্নি-৬ ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর। সরকারিভাবে কোনও ঘোষণা না হলেও, সূত্রের দাবি, অগ্নি-৬ ক্ষেপণাস্ত্রের অপর নাম SURYA। 


এর পাশাপাশি, ভারতের হাতে আরও বেশ কয়েকটি ভূমিতে আঘাত করতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জাহাজ থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষপণাস্ত্র DHANUSH। এটি মূলত পৃথ্বীর নৌ-সংস্করণ। ভারতের হাতে রয়েছে SHAURYA, PRAHAR। 



আকাশ থেকে ভূমি ক্ষেপণাস্ত্র (ASM) -


এই তালিকায় ভারতের হাতে এসেছে অন্যতম সেরা দূরপাল্লার SCALP ক্ষেপণাস্ত্র। রাফাল যুদ্ধবিমান এই ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত। এছাড়া, এই শ্রেণিতে ভারতের হাতে আছে দুটি ক্রুজ প্রজাতির ক্ষেপণাস্ত্রও।



ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র -


পূর্ব-নির্ধারিত কোনও লক্ষ্যস্তুকে (ভূমি বা জলের ওপর, যেমন সামরিক ঘাঁটি বা জাহাজ) ধ্বংস করতে ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই শ্রেণিতে ভারতের অন্য দেশের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। ভারত ও রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে তৈরি BRAHMOS ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা। সুপারসনিক (শব্দের চেয়ে তিনগুণ) ক্রুজ মিসাইলের অধিকারী হিসেবে গর্ববোধ করতেই পারে ভারত।


বর্তমানে এই ক্ষেপণাস্ত্রের চারটি ভিন্ন সংস্করণ রয়েছে। একটি ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য, একটি জাহাজ থেকে নিক্ষেপযোগ্য একটি বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য (আকাশ থেকে ভূমি ক্ষেপণাস্ত্র সম) ও চতুর্থ সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য। এর পাশাপাশি, এখন হাইপারসনিক ভার্সানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বলা হচ্ছে, এটি শব্দের চেয়ে সাতগুণ দ্রুত গতিতে যাবে। এর পাশাপাশি, ভারতের হাতে আরও কয়েকটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য -- NIRBHAYA ও EXOCET। 



সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র (SLBM) -


এই শ্রেণিতে ভারতের মূল শক্তি হল K-4 ও K-15 (অপর নাম SAGARIKA) ক্ষেপণাস্ত্র। এছাড়া, বর্তমানে, K-5 ও K-6 ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা চলছে। এখানে রাখা প্রয়োজন, এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি পরমাণি অস্ত্রবহনে সক্ষম। 



ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র (ATGM) -


এই শ্রেণিতে ভারতের মূল স্তম্ভ হল NAG ক্ষেপণাস্ত্র। বর্তমানে এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাঁচটি ভিন্ন সংস্করণ রয়েছে। স্থল-ভার্সানের নাম - PROSPINA। হেলিকপ্টার থেকে নিক্ষেপযোগ্য  সংস্করণের নাম - HELINA বা DHRUVASTRA। কাঁধে করে বহন করা যায় এমন সংস্করণ যার নাম - MPATGM। এছাড়া, নিজস্ব কেরিয়ারের মাধ্যমেও নিক্ষেপ করা যায় এমন একটি ভার্সান রয়েছে, নাম- NAMICA। হেলিনার একটি আধুনিক সংস্করণও রয়েছে নাম - SANT। এর পাশাপাশি, ভারতের আরও ২ ধরনের ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। একটির নাম - AMOGH। অপরটি CLGM। 



স্যাটেলাইট-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র (ASAT) -


২০১৯ সালে স্যাটেলাইট-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ভারত। এই প্রযুক্তি ভারত বাদে বিশ্বের আর ৫টি দেশের কাছে রয়েছে। ওই পরীক্ষার নাম দেওয়া হয়েছিল মিশন-শক্তি। ক্ষেপণাস্ত্রের নামকরণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। 



অ্যান্টি-রেডিয়েশন ক্ষেপণাস্ত্র (ARM) -


এটি অনেকটা আকাশ থেকে ভূমি ক্ষেপণাস্ত্রের মতো। তবে, এর ব্যবহার একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে। বা বলা ভাল, এক ধরনের বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতেই এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়ে থাকে।  অ্যান্টি-রেডিয়েশন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয় শত্রুর রেডারকে ধ্বংস করার জন্য। নজরদারি রেডার থেকে উৎপন্ন রেডিয়েশন নির্ধারণ করে এটি আঘাত হানতে সক্ষম। শত্রুর এয়ার ডিফেন্স থেকে শুরু করে মিসাইল ডিফেন্স ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অকেজো করতে এই অস্ত্রের ব্যবহার। সম্প্রতি, ভারত এমন একটি ক্ষেপণাস্ত্র নাম RUDRAM-1 এর পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করেছে।