কলকাতা: আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২২ সাল ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ। ওই বছর ভারতীয় নৌসেনার কাছে ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। কারণ, আগামী বছর ভারতীয় নৌসেনায় আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে দেশে তৈরি প্রথম বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্ত-এর।
বর্তমানে সামুদ্রিক ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে এই রণতরী। চলতি সপ্তাহে প্রথম ট্রায়াল শেষ করে তা ফিরে এসেছে। এখনও আরও বেশ কয়েকটা ট্রায়াল হবে।
২০২২ সালে বিক্রান্ত-এর অন্তর্ভুক্তির প্রসঙ্গে সম্প্রতি প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেছেন, স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষের জন্য এর চেয়ে ভাল উপহার আর কিছুই হতে পারে না।
তবে, একা বিক্রান্ত নয়। আগামী বছর নৌসেনার মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত হতে চলেছে। ওই বছরই নৌসেনার হাতে আসতে চলেছে দেশে তৈরি সর্বাধুনিক ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির যুদ্ধজাহাজও।
বিক্রান্ত-এর ছায়ায় থেকে গেলেও, ভারতের এই নতুন স্টেল্থ গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার নিয়ে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কৌতুহলের অন্ত নেই।
প্রোজেক্ট ১৫বি-র ইতিহাস
২০১১ সালে ভারতীয় নৌসেনার আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে সবুজ সঙ্কেত পেয়েছিল "প্রোজেক্ট ১৫বি"। এই প্রকল্পের আওতায় চারটি স্টেল্থ গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
বর্তমানে ভারতীয় নৌসেনার প্রধান স্টেল্থ গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার কলকাতা ক্লাস-এর উন্নত ভার্সান হিসেবেই তৈরি করা হয়েছে এই নতুন যুদ্ধজাহাজ।
এই শ্রেণিতে মোট চারটি স্টেল্থ গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার তৈরি হচ্ছে। প্রথমটির বর্তমানে সি-ট্রায়াল চলছে। নাম রাখা হয়েছে আইএনএস বিশাখাপত্তনম।
ফলত, এই শ্রেণির বাকি তিনটি জাহাজ বিশাখাপত্তনম ক্লাসের হবে। অর্থাৎ, বিশাখাপত্তনমের বৈশিষ্ট্য হুবহু মেনেই তৈরি হচ্ছে সেগুলি।
এবার আসা যাক আইএনএস বিশাখাপত্তনম-এর কথায়। মুম্বইয়ের মাজগাঁও ডকইয়ার্ড লিমিটেডে (এমডিএল) জাহাজ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে। উদ্বোধন হয় ২০১৫ সালে।
গত বছর থেকে জাহাজটির ট্রায়াল শুরু হয়েছে। আগামী বছর তা ভারতীয় নৌসেনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে নৌসেনা সূত্রে খবর।
এই শ্রেণির (বিশাখাপত্তনম ক্লাস) বাকি তিন জাহাজগুলি হল -- আইএনএস মর্মুগাও, আইএনএস ইম্ফল ও আইএনএস পোরবন্দর। এই তিন জাহাজগুলির মধ্যে প্রথম দুটি বেসিন ট্রায়াল চলছে। শেষোক্ত নির্মাণ পর্যায়ে রয়েছে।
প্রোজেক্ট ১৫বি-র নকশা ও বৈশিষ্ট্য
প্রোজেক্ট ১৫বি - বা বিশাখাপত্তনম শ্রেণির জাহাজগুলির নকশা কলকাতা ক্লাস-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি হলেও, এতে অনেক আধুনীকিকরণ করা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল, এই জাহাজের স্টেল্থ বৈশিষ্ট্যকে আরও উন্নত করা হয়েছে। পাশাপাশি, জাহাজে আরও অধিকমাত্রায় অটোমেশন প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এর ফলে, জাহাজগুলি আয়ু বৃদ্ধি হবে। সমুদ্রে দীর্ঘ সময় যুঝতে পারবে এবং জলে এরা প্রচণ্ড ক্ষীপ্র হবে। জাহাজের নকশা এমন মসৃণ করা হয়েছে যাতে শত্রুর রেডারে সনাক্ত করা আরও কঠিন হবে। কারণ, বাইরের দিকটা পুরোটাই রেডার-ট্রান্সপারেট ফিটিং দিতে তৈরি।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভার এবং সেন্সরের সাহায্যে এই আইএনএস বিশাখাপত্তনম ও তার গোত্রীয় জাহাজগুলি হয়ে উঠবে বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার।
প্রতিটি জাহাজের দৈর্ঘ্য ১৬৩ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় সাড়ে ১৭ মিটার। জলে এর ভর প্রায় ৭,৪০০ টন। প্রত্য়েকটিতে একসঙ্গে ৫০ জন অফিসার এবং ২৫০ জন নাবিক সহ ৩৫০ ক্রুর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
নতুন জাহাজে বাহিনীর থাকা ও কাজের পরিবেশ ও জায়গার ওপর বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যাতে, দীর্ঘ সময় এই জাহাজে থাকার ধকল যাতে অফিসার ও নাবিকদের শরীর-মনে না প্রভাব ফেলে।
প্রোজেক্ট ১৫বি-র অস্ত্রভাণ্ডার
নামের সঙ্গে সঙ্গত রেখে চলে যে কোনও ডেস্ট্রায়ারের অস্ত্রসম্ভার। এক কথায়, যে কোনও ডেস্ট্রয়ারের তূণীরে এত ধরনের অস্ত্র মজুত থাকে, যে একা হাতে একটা লড়াই জেতার ক্ষমতা রাখে।
ভারতের ডেস্ট্রয়ারগুলিও তার ব্যতিক্রম নয়। আর আইএনএস বিশাখাপত্তনম ডেস্ট্রয়ার যে সর্বাধুনিক অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দূরপাল্লার উপকূল এবং সমুদ্র ভিত্তিক লক্ষ্যবস্তুর জন্য এই জাহাজের অস্ত্রসম্ভারের মূল শক্তি হিসেবে রয়েছে লম্বালম্বি উৎক্ষেপণযোগ্য (ভার্টিকাল লঞ্চ) ইজরায়েলি বারাক ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র (এসএএম) এবং ব্রহ্মোস ভূমি থেকে ভূমি ক্ষেপণাস্ত্র (এসএসএম)।
জাহাজে থাকা দুটি ১৬-চেম্বার বিশিষ্ট উল্লম্ব লঞ্চার থেকে মোট ৩২টি বারাক-৮ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা যাবে। দুটি আট-চেম্বার বিশিষ্ট উল্লম্ব লঞ্চার মডিউল থেকে ১৬টি ব্রহ্মোস উৎক্ষেপণ করা যাবে।
এছাড়া, জাহাজের সামনের ডেকে রয়েছে ১২৭ মিমি ৬২ ক্যালিবার এমকে-৪৫ প্রধান আর্টিলারি বন্দুক। পাশাপাশি, কম-দূরত্বের জন্য এতে রয়েছে চারটি একে-৬৩০ ৩০এমএম আর্টিলারি বন্দুক।
এখানেই শেষ নয়। এই শ্রেণির প্রত্যেকটি জাহাজে থাকবে চারটি ৫৩৩ এমএম টর্পেডো লঞ্চার এবং ২টি আরবিইউ-৬০০০ অ্যান্টি-সাবমেরিন রকেট লঞ্চার। অর্থাৎ, এই জাহাজে জুড়ে দেওয়া হয়েছে সাবমেরিন-বিধ্বংসী (এএসডব্লু) ক্ষমতাও।
প্রোজেক্ট ১৫বি-র অতিরিক্ত সুবিধা
পি ১৫বি জাহাজের পিছনের দিকে রয়েছে আধুনিক হেলি-ডেক। সেখানে সি কিং বা হ্যাল ধ্রুব হেলিকপ্টার সহ দুটি মাল্টি-রোল রটারক্রাফ্টের ল্যান্ডিং ও হ্যাঙারের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া, এই জাহাজে রয়েছে অত্যাধুনিক ও পূর্ণ বাতাস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। যা ক্রুকে যে কোনও রাসায়নিক, জৈবিক এবং পারমাণবিক হামলা থেকে রক্ষা করবে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং সেন্সর প্যাকেজের দৌলতে এই জাহাজগুলি বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার হতে চলেছে।