কলকাতা: গত বছরের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্রের তালিকায় নতুন পালক সংযোজিত হয়েছিল। দেশে তৈরি প্রথম কোনও অ্যান্টি-রেডিয়েশন মিসাইল (এআরএম) বা রেডার-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র "রুদ্রম ১"-এর সফল পরীক্ষা করেছিল প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও। 


বায়ুসেনার সুখোই-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান থেকে পরীক্ষামূলক নিক্ষেপ করা হয়েছিল ওই ক্ষেপণাস্ত্র। ডিআরডিও জানায়, একেবারে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যে আছড়ে পড়েছিল রুদ্রম ১।


এই পরীক্ষা ভারতকে এক লপ্তে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে দেয়। আধুনিক রণকৌশলের নিরিখে এটা একটা বিরাট লাফ বলে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 


আধুনিক যুদ্ধের প্রেক্ষিতে এই সাফল্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। কেন তাঁরা এমনটা মনে করছেন, তার ব্যাখ্যাও দেন বিশেষজ্ঞরা। 


কী এই অ্যান্টি-রেডিয়েশন মিসাইল?


রুদ্রম ১ সম্পর্কে জানার আগে, অ্যান্টি-রেডিয়েশন মিসাইল সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। 


আধুনিক দিনের যুদ্ধ ও তার কৌশল আরও বেশি করে নেটওয়ার্ক-কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, এমন একটা নেটওয়ার্ক যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে বিস্তৃত চিহ্নিতকরণ, নজরদারি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা। 


একটা দেশের আকাশসীমার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা তার প্রতিরক্ষা যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমান যুগে আকাশপথে শত্রুর হানা থেকে দেশকে সুরক্ষিত রাখা হয়ে থাকে। 


যে কোনও বিপদ এলে, এই যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমেই তা সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করে দেয় এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেয়।  আর এই যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান অঙ্গ হল রেডার। 


সামরিক ঘাঁটি বা দেশের যে কোনও প্রান্তে মোতায়েন রেডারের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিন সঙ্কেতের মাধ্যমে আকাশসীমায় নজর রাখে রেডার। সহজ কথায়, রেডার হল আকাশসীমার কান ও চোখ। একটা দেশের এয়ার ডিফেন্স বা আকাশসীমা প্রতিরক্ষা পুরোটাই এই রেডার সিস্টেমের ওপর নির্ভরশীল।


ফলে, শত্রুর এই রেডার ব্যবস্থাকে অকেজো করতে পারলে, রক্ত ঝরার আগেই যুদ্ধের অর্ধেকটা চলে আসবে আয়ত্তে। সেক্ষেত্রে, সবার আগে, ধ্বংস করে ফেলতে হবে এই রেডারের কার্যকারিতাকে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধের ফল নির্ধারণ করে দিতে পারে। 


আর এই কাজে বিশেষভাবে পারদর্শী অ্যান্টি-রেডিয়েশন মিসাইল। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি প্রতিপক্ষের আকাশসীমা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত রেডার, যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্যান্য রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির উৎস সনাক্ত, ট্র্যাক এবং তা ধ্বংস করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। 


এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি শত্রুর যে কোনও জ্যামিং প্ল্যাটফর্মের জাল ছিঁড়তে করতে বা রেডার স্টেশনগুলিকে অকেজো করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। এর ফলে, নিজ যুদ্ধবিমানগুলি অনায়াসে বিনা বধায় শত্রুর আকাশসীমায় প্রবেশ করতে পারবে। যুদ্ধবিমানের পথ পরিষ্কার করার পাশাপাশি, নিজের সিস্টেমগুলিকে জ্যাম করা থেকেও রুখে দেয় এই ক্ষেপণাস্ত্র।


ক্ষেপণাস্ত্রের নেভিগেশন মেকানিজমে একটি "ইনারশিয়াল নেভিগেশন সিস্টেম" রয়েছে। এটি একটি কম্পিউটারাইজড মেকানিজম যা বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তনকে ব্যবহার করে। সঙ্গে থাকে স্যাটেলাইট ভিত্তিক জিপিএস।


এছাড়া, গাইডেন্স হিসেবে এতে রয়েছে একটি "প্যাসিভ হোমিং হেড" - এটি একটি সিস্টেম যা বিস্তৃত ব্যান্ডের মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুর রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির উৎস সনাক্ত ও চিহ্নিত করে তাকে ধ্বংস করে দেয়।


নিউ জেনারেশন এন্টি রেডিয়েশন মিসাইল রুদ্রম-১ 


এবার আসা যাক রুদ্রম ১-এর প্রসঙ্গে। ভারতীয় বায়ুসেনার ব্যবহারের জন্যই তৈরি করা হয়েছে এই ক্ষেপণাস্ত্র। শত্রুর আকাশসীমায় প্রবেশ করতে হলে, আগে তার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকেজো করতে হবে। সামরিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় সাপ্রেসন অফ এনিমি এয়ার ডিফেন্স (সিড)। বায়ুসেনার এই প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে রুদ্রম-কে।


রুদ্রম ক্ষেপণাস্ত্রটি লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করে তাকে 'লক' করে।  একবার লক হলে, ক্ষেপণাস্ত্রকে আর রোখা যায় না। এমনকী, রেডিয়েশনের উৎস বন্ধ করা হলেও, ১০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে এই ক্ষেপণাস্ত্র সঠিকভাবে যে শত্রুর রেডার সিস্টেমে আঘাত করতে সক্ষম।


রুদ্রম ১ ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি করে ডিআরডিও। এটি প্রথম দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি রেডার-বিধ্বংসী আকাশ থেকে ভূমি (এএসএম) ক্ষেপণাস্ত্র। গতবছর এই নিউ জেনারেশন এন্টি রেডিয়েশন মিসাইল (এনজিআরএএম) বা রুদ্রম ১ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা হয় ওড়িশার বালাসোরে ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট রেঞ্জে। 


বর্তমানে ক্ষেপণাস্ত্রটিকে সুখোই-৩০এমকেআই যুদ্ধবিমানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ডিআরডিও জানিয়েছে, ভবিষ্যতে অন্য যুদ্ধবিমান যেমন রাফাল, তেজসেও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ভূপৃষ্ঠের ৫০০ মিটার থেকে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উচ্চতা থেকে বিমানের মাধ্যমে নিক্ষেপ করা যেতে পারে। এটির সর্বোচ্চ গতি শব্দের চেয়ে দু'গুণ বেশি।


বায়ুসেনা সূত্রের খবর, এখনও এই ক্ষেপণাস্ত্রের আরও ৬-৭টি পরীক্ষা বাকি। একবার সেগুলি সম্পন্ন হলে, ২০২৩ সাল নাগাদ এটি বায়ুসেনার অস্ত্রাগারে প্রবেশের অনুমতি পাবে।