নয়াদিল্লি: পূর্ব লাদাখের প্যাংগং সো (Pangong Tso area) থেকে সেনা সরানো শুরু করেছে ভারত ও চিন। চিন তাদের সেনা ফিঙ্গার ৮ পয়েন্টে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে, ভারতীয় সেনা প্যাংগং লেকের উত্তর দিকে ফিঙ্গার ৩-এর দিকে সরে যাচ্ছে। একইরকম ভাবে প্যাংগং লেকের দক্ষিণ দিকেও এইভাবে সেনা সরানোর কাজ চলবে বলে বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় জানিয়েছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং।


রাজনাথ জানান, প্যাংগং হৃদের উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তে অস্ত্র পরিহার করতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি এটা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, চিনের সঙ্গে নিরন্তর আলোচনা ও আমাদের সুচিন্তন পদ্ধতির দৌলতে আমরা প্যাংগং লেকের উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তে যৌথ নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি।’’ প্রতিরক্ষামন্ত্রী যোগ করেন, সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের ৪৮-ঘণ্টার মধ্যে দুপক্ষের শীর্ষ কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠক হবে। সেখানে সীমান্ত সম্পর্কিত যাবতীয় ইস্যুগুলি নিয়ে আলোচনা হবে এবং সমাধানসূত্র খোঁজার চেষ্টা হবে।


রাজনাথ জানান, নতুন চুক্তি অনুযায়ী, ফরোয়ার্ড এরিয়ায় পর্যায়ক্রম ও সমন্বয়ে বাহিনী মোতায়েন কমিয়ে ফেলবে ভারত ও চিন। তিনি যোগ করেন, প্যাংগং লেকের উত্তর প্রান্তে ফিঙ্গার ৮-এর পূর্বদিকে বাহিনী রেখে দেবে চিন। অন্যদিকে, ফিঙ্গার থ্রি-র কাছে সেনা মোতায়েন রাখবে ভারত। একইভাবে হৃদের দক্ষিণ প্রান্তেও ঐকমত্যে বাহিনী মোতায়েন সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলেও জানান প্রতিরক্ষামন্ত্রী।


একইসঙ্গে দুই পক্ষই ওই অঞ্চলে নির্মিত সামরিক নির্মাণ সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে রাজি হয়েছে। সেনা সরানোর প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর দুই দেশের শীর্ষ সেনা কমান্ড্যান্টরা বৈঠক করবেন বলে জানা গিয়েছে। ভারত সীমান্তের এক ইঞ্চি জমিও কাউকে ছাড়বে না বলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন রাজনাথ। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে অদূর ভবিষ্যতে আরও পদক্ষেপ করা হবে বলে তিনি এদিন আশ্বস্ত করেছেন। এদিন তিনি সংসদে বলেছেন, “পূর্ব লাদাখের প্যাংগং লেকে সেনা সরানো নিয়ে চিনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির দিকে এগোচ্ছে ভারত।”


লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি)-য় উত্তেজনা কমাতে ‘মুখোমুখি অবস্থান থেকে সেনা পিছনো’ (ডিসএনগেজমেন্ট) দেখে বলা যেতেই পারে যে, দুই দেশের সম্পর্কের বরফ হয়তো গলতে শুরু করেছে৷ গতকালই এক বিবৃতি জারি করে চিনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক পূর্ব লাদাখ থেকে দুই দেশের সামরিক সম্ভার সরানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল৷ জানা যায় দ্বিপাক্ষিক নবম পর্বের কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠকের সুত্র ধরে এই সিদ্ধান্তে এসেছে দুই দেশ৷ ভারতীয় সেনা প্যাংগং লেকের উত্তর দিকে ফিঙ্গার ৩-এর দিকে সরে যাচ্ছে। অন্যদিকে চিন তাদের সেনা ফিঙ্গার ৮ পয়েন্টে দিকে সরিয়ে নিচ্ছে৷


ফিঙ্গার এরিয়াতে আসল ঝামেলা শুরু হয় ১৯৯৯ সাল থেকে ৷ ওই সময় কার্গিলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছিল ৷ তখন এই এলাকায় চিন পেট্রোলিং করার কথা বলে ফিঙ্গার ৮ থেকে ৫ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করে নেয় ৷ গত বছর এপ্রিল-মে (২০২০) পর্যন্ত ভারতীয় সেনা মনে করত যে এলএসি-র কন্ট্রোল ফিঙ্গার ৪ এবং ৫-এর মধ্যে থাকে ৷ কারণ চিনের রাস্তা ফিঙ্গার ৫ পর্যন্তই ছিল ৷  


পাশাপাশি, এই কনকনে ঠান্ডায় যেভাবে ওই অঞ্চলে ভারতীয় সেনা লালফৌজের আগ্রাসন রুখে দিয়েছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। বলেছেন, “ভারতীয় সেনা এই প্রতিকূল আবহাওয়াতেও পরাক্রম ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে পূর্ব লাদাখে। তাঁদের বলিদান দেশ কখনও ভুলবে না। আমাদের মূল লক্ষ্য হল, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় স্থিতাবস্থা ও শান্তি বজায় রাখা। তার থেকে পিছু হটবে না ভারত।”


ঘরোয়া ভাবে আলোচনার সময়ে দিল্লির অভিযোগ, ওই এলাকায় এলএসি পরবর্তী ‘বাফার জ়োন’ অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডে গেড়ে বসেছে চিনা সেনা। এ-ও মানছে যে, ওই আগ্রাসী পদক্ষেপের পাল্টা হিসেবে প্যাংগংয়ের দক্ষিণে ৭টি গিরিশৃঙ্গের দখল নিয়েছে ভারতও। যেখানে আগে দুই দেশের কারও দখলদারি ছিল না। সূত্রের খবর, বৈঠকে অরুণাচলপ্রদেশে চিনা সেনার আগ্রাসী আচরণের প্রসঙ্গও তুলেছে ভারত। উত্তর সুবনসিরি জেলায় সীমান্ত লঙ্ঘন করে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে সেখানে চিনা ফৌজের আস্ত একটি গ্রাম তৈরি করে ফেলার সংবাদে সম্প্রতি চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে সাউথ ব্লকে। এ বিষয়ে উদ্বেগের কথা তাই জানানো হয়েছে চিনা সেনাকে।


সংসদে রাজনাথ আরও জানান, ২০২০ এপ্রিল থেকে লেকের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে উভয় পক্ষ যে যে কাঠামো গড়েছে, তা ঐকমত্যের ভিত্তিতে ও পর্যায়েক্রমে সরিয়ে উপত্যকাকে আগের পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি, সেনা প্যাট্রলিং সমেত প্যাংগংয়ের উত্তর প্রান্তে সামরিক ব্যস্ততা কমিয়ে ফেলতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। গত বছরের এপ্রিল-মে মাস থেকে পূর্ব লাদাখে লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল(এলএসি) বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘাতের আবহ বজায় রেখেছিল ভারত ও চিন। দু’পক্ষই সীমান্তে বিপুল বাহিনী মোতায়েন করতে শুরু করে। যা ঘিরে সীমান্তে প্রবল উত্তেজনার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গত ২৪ জানুয়ারি, মোলদো-চুলশুল সীমান্তে দুদেশের কোর কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠকে পূর্ব লাদাখে প্রাথমিকভাবে সামরিক সম্ভার কমানোর ইঙ্গিত মেলে।