নয়াদিল্লি: ইজরায়েল বনাম হামাস যুদ্ধ দিয়ে শুরু হয়েছিল একবছর আগে। তখন থেকেই পশ্চিম এশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রমাদ গুনছিলেন অনেকে। গত কয়েক দিন ধরে যা চলছে, তাতে সেই আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হতে চলেছে। প্যালেস্তাইনে মৃত্যুমিছিল চলাকালীনই লেবাননে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। হামলা চালানো হয়েছে ইয়েমেনেও। এমন পরিস্থিতিতে ছায়াযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এবার সরাসরি ইজরায়েলে হামলা চালাল ইরান। আর তাতেই পশ্চিম এশিয়ায় বিরাট যুদ্ধ ঘনিয়ে এসেছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। ইরানের দাবি, আত্মরক্ষার্থেই ইজরায়েলে হামলা চালিয়েছে তারা। ইজরায়েল যদি পাল্টা আক্রমণ চালায়, তার ফল মারাত্মক হবে। অন্য দিকে, ইজরায়েল জানিয়েছে, এর প্রতিশোধ তুলেই ছাড়বে তারা। (Iran-Israel War)


মঙ্গলবার ইজরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধকারী যে আয়রন ডোম প্রযুক্তি রয়েছে ইজরায়েলের কাছে, তার সাহায্যে বহু ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ আকাশেই গুঁডিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তিন দিক দিয়ে মুহুর্মুহু আক্রমণ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় ইজরায়েলকে। ফলে দেশের মধ্য এবং দক্ষিণ ভাগে পর পর আছড়ে পড়ে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র। জেরুসালেমেও ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ে বলে জানা যাচ্ছে। সাইরেনের শব্দ শুনে রাতেই নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান ইজরায়েলি নাগরিকরা। কয়েক জন আহত হওয়া ছাড়া তেমন কিছু ঘটেনি বলে জানিয়েছে ইজরায়েল। তবে অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে শার্পনেল লেগে এক প্যালেস্তিনীয় নাগরিক মারা গিয়েছেন বলে খবর। (Middle East War Situation)


ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, "বড় ভুল করে ফেলেছে ইরান। ওদের এর মূল্য চোকাতেই হবে।" ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মেজর জেনারেল হার্জি হালেভি বলেন, "কখন সুদে-আসলে মূল্য উশুল করব, তা আমরাই ঠিক করব। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন নির্দেশ দেবেন, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, অতর্কিতে আক্রমণ চালাব।" ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হেগারি বলেন, "ইরান হামলা চালানোয় পরিস্থিতি আরও গুরুতর এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এর ফল ভোগ করতে হবে। আমরা এর জবাব দেব, যেখানে, যখন, যেভাবে ইচ্ছে হবে, ইজরায়েল সরকারের নির্দেশ মতো কাজ করব।" ইজরায়েলকে লক্ষ্য কের ইরান হামলা চালানর পর আমেরিকাও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সালিভান বলেন, "ইরানই সংঘাত বাড়াল, যা গুরুতর বিষয়।  আমরা পরিষ্কার জানিয়েছে, এর ফল ভুগতে হবে। এই হামলার ফল হবে মারাত্মক।  আর তাতে ইজরায়েলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করব আমরা।"



অন্য দিকে, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, 'বৈধ অধিকারের উপর ভিত্তি করে, ইরানের শান্তি এবং নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ইহুদি আগ্রাসনের জবাব দেওয়া হয়েছে। ইরানের নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় এই পদক্ষেপ করা হয়েছে। নেতানিয়াহুকে জানাতে চাই, ইরান যুদ্ধবাজ নয়। কিন্তু যে কোনও হুমকির মুখে দৃঢ় অবস্থান নেয়। আমাদের ক্ষমতার একটি ঝলক দেখলেন মাত্র। ইরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়াবেন না'। ইরানের বিদেশমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরঘচি লেখেন, 'আত্মরক্ষায় পদক্ষেপ করেছি আমরা, যা রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুচ্ছেদ ৫১-এর আওতায় পড়ে। শুধুমাত্র সামরিক শিবিরগুলিতে হামলা চালানো হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে গাজা এবং লেবাননে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য সময় দিয়েছিলাম আমরা। প্রায় দু'মাস ধরে আটকে রেখেছিলাম নিজেদের। আমাদের অভিযান শেষ হয়েছে। ইজরায়েল যদি ফের হামলা চালায়, আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ করব আমরা। ইজরায়েলকে যারা সমর্থন করছে, তেল আভিভের যুদ্ধবাজদের লাগাম টানার ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল'। ইরানের সর্বোচ্চ শাসক সৈয়দ আলি হোসেইনি খামেনেইয়ের বক্তব্য, 'সর্বশক্তিমান ওপরওয়ালার সহযোগিতায় যে অভ্যুত্থান ঘটছে, তার আঘাত জীর্ণ এবং পচনশীল ইহুদি শাসকের জন্য আরও বেদনাদায়ক ও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে, পচন ধরবে তাদের শরীরে।'



আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, ইরানের আক্রমণ থেকে ইজরায়েলকে রক্ষা করতে প্রস্তুত আমেরিকা। ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সবরকম সহযোগিতা করতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। যদিও ইরানের দাবি, লেবাননে যে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল, গাজায় যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, তারই জবাব দিয়েছে তারা।  ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর তরফে বিবৃতি প্রকাশ করে জানানো হয়, ইজরায়েল পাল্টা আক্রমণ চালাতে এলে, উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে তাদের প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো। শুধু তাই নয়, ইজরায়েলের সহযোগী দেশের যে সম্পত্তি রয়েছে পশ্চিম এশিয়ায়, তাও ধ্বংসের হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। ইয়েমেনের সশস্ত্র সংগঠন হুথি জানিয়েছে, ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযান আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে তারা। আমেরিকা এবং ব্রিটেনের মতো দেশ যেভাবে ইজরায়েলকে সমর্থন জোগাচ্ছে, তাতে তাদের স্বার্থ লঙ্ঘিত হচ্ছে। 



ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল মাকরঁ ইজরায়েলের উপর ইরানের এই হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন। হেজবোল্লাকে পিছু হটার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি, লেবাননের সার্বভৌমিকতা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদনও জানিয়েছেন।  রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব মেনে পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি ফেরানোর পক্ষে সওয়াল করেছেন মাকরঁ। যদিও শান্তি ফেরার কোনও ইঙ্গিতই এই মুহূর্তে চোখে পড়ছে না পশ্চিম এশিয়ায়। কারণ ইরানকে জবাব দিতে বড় পরিকল্পনা রয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ইজরায়েলি আধিকারিকরা। তাঁদের দাবি, প্রতিশোধের মতো প্রতিশোধ তুলবে ইজরায়েল। ইরানের তেল উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে হামলা চালানো হতে পারে বলেও জল্পনা উস্কে দিয়েছেন এক আধিকারিক। ইজরায়েলি বাহিনী জানিয়েছে, বুধবার সকালে সড়কপথে তাদের অতিরিক্ত সেনা লেবাননে প্রবেশ করেছে। ইরানের মোকাবিলায় ফ্রান্সের তরফেও পশ্চিম এশিয়ায় সেনা পাঠানো হচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদকে এ নিয়ে বৈঠকের আর্জিও জানিয়েছে তারা। মাকরঁ বলেন, "ইজরায়েলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমরা। ইরানের মোকাবিলা করতে সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফ্রান্স।"


আর এতকিছুর মধ্যেও প্যালেস্তাইনের গাজা এবং লেবাননের বেইরুটে ইজরায়েল লাতাগার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে বলে খবর।  বেইরুটের দক্ষিণ অংশে ইরান মদতপুষ্ট হেজবোল্লার একাধিক ঘাঁটি রয়েছে। সেখানে লাগাতার বোমাবর্ষণ চলছে। রকেটের আঘাতে বেশ কয়েক জন মারা গিয়েছেন বলে খবর। শহর এবং শহরতলি থেকে সাধারণ মানুষকে সরে যেতে নির্দেশ নিয়েছে ইজরায়েল। হেজবোল্লার দাবি, বুধবার সকালে লেবাননের আদেইসে শহরে ঢুকে পড়েছে ইজরায়েলি বাহিনী। সেখানে দু'পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে ইজরায়েলি বাহিনী পিছু হটে বলে দাবি তাদের। প্যালেস্তাইনের রেডিও চ্যানেল Voice of Palestine জানিয়েছে, গাজার একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন বহু মানুষ। সেখানেও হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল, যাতে শিশু-সহ ৩০ জনের বেশি প্যালেস্তিনীয় নাগরিক মারা গিয়েছেন।



এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পশ্চিম এশিয়ায় উড়ান পরিষেবা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে একাধিক বিমান পরিবহণ সংস্থা। Aegean Airlines জানিয়েছে, ৩১ অক্টোবর বেইরুট বিমান পরিষেবা বন্ধ রাখছে তারা। ৬ অক্টোবর পর্যন্ত পরিষেবা বন্ধ থাকছে তেল আভিভে।  Air Europa আপাতত ২ অক্টোবর পর্যন্ত তেল আভিভে পরিষেবা বন্ধ রাখছে। ৮ অক্টোবর পর্যন্ত তেল আভিভ এবং বেইরুট রুটে পরিষেবা বন্ধ রাখছে Air France-KLM. Bulgaria AIR ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত পরিষেবা বন্ধ রাখছে ইজরায়েলে। EASYJET ২০২৫ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত তেল আভিভে বিমান পরিষেবা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে এ বছর এপ্রিল মাসেই। IAG ৭ অক্টোবর পর্যন্ত তেল আভিভ পর্যন্ত পরিষেবা বন্ধ রাখছে, Vueling ১২ জানুয়ারি পর্যন্ততেল আভিভে পরিষেবা বন্ধ রাখছে, পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত আম্মানেও বন্ধ থাকবে পরিষেবা।


ITA Airways ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তেল আভিভে পরিষেবা দেবে না। LOT ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লেবাননে পরিষেবা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। Luftansa Group জানিয়েছে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তেল আভিভে, ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত তেহরানে এবং ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বেইরুটে পরিষেবা বন্ধ থাকবে। আপাতত ইরান, ইরাক, জর্ডানের আকাশসীমা ব্যবহারও করবে না তারা। SunExpress ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেইরুটে পরিষেবা দেবে না। ৭ অক্টোবর পর্যন্ত বেইরুটে পরিষেবা দেবে না তুরস্কের Pegasus. ইউরোপের বৃহত্তম বাজেট বিমান সংস্থা ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত তেল আভিভের সমস্ত বিমান বাতিল করেছে। Sundair অক্টোবর মাসে বার্লিন-বেইরুট এবং ব্রেমেন-বেইরুট লাইনে পরিষেবা বন্ধ রাখছে আপাতত। Air ALGERIE পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত লেবাননে পরিষেবা দেবে না। AIR INDIA তেল আভিভে পরিষেবা আপাতত বন্ধ রাখছে। CATHAY Pacific ২০২৫ সাল পর্যন্ত তেল আভিভে বিমান পরিষেবা বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে সকলকে। Delta Air Lines ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিষেবা দেবে না তেল আভিভে। Emirates দুবাই-বেইরুট রুটে পরিষেবা বন্ধ রাখছে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত। Etihad Airways, Fly Dubai, Iran Air, Iraqui Airways, QAtar Airways, United Airways-ও একই পথে হাঁটছে।