নয়াদিল্লি: হিজাব ঠিক ভাবে পরেননি। নিজের প্রাণ দিয়ে তার মাশুল গুনতে হয়েছিল ২২ বছরের মাহসা আমিনিকে। সেই নিয়ে বিক্ষোভ-আন্দোলনের আগুন জ্বললেও, পরিস্থিতি বদলায়নি ইরানে। পোশাক নিয়ে নীতি পুলিশের হাতে হেনস্থা হয়ে চলেছেন মহিলারা। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে পোশাকবিধি কার্যকর হলে, বিশিষ্টজনের ক্ষেত্রে তা কেন হবে না, প্রশ্ন উঠছে ইরানে। কারণ দেশের সর্বোচ্চ শাসক, আয়াতোল্লা আল খামেনেইয়ের শীর্ষ উপদেষ্টার মেয়েই খোলামেলা পোশাকে বিয়ে করলেন। আর তাতেই নতুন করে তেতে উঠছে ইরানের পরিস্থিতি। (Iran Hijab Controversy)

Continues below advertisement

গত সপ্তাহে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যাতে রেয়ার অ্যাডমিরাল আলি শামখানির মেয়ে সেতায়েশকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়। গতবছর মে মাসে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সেতায়েশ। কিন্তু বিয়ের ভিডিও সামনে আসে সম্প্রতি। আলি শামখানি আয়াতোল্লার ঘনিষ্ঠ এবং শীর্ষ উপদেষ্টা। ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিওরিটি কাউন্সিলের প্রাক্তন সচিবও ছিলেন। ভিডিও-য় দেখা যায়, খোলামেলা পোশাক পরিহিত মেয়েকে হাত ধরে বিয়ের মণ্ডপে নিয়ে যাচ্ছেন খোদ আলি শামখানিই। (Iran News)

সেতায়েশের পরনের পোশাকটি গোড়াতেই নজর কেড়ে নেয় সকলের। কারণ সাদা রংয়ের একটি স্ট্র্যাপলেস গাউন পরেছিলেন তিনি। অর্থাৎ বক্ষভাগের উপর থেকে কাঁধের অংশ, হাত সম্পূর্ণ খোলা ছিল। শুধু তাই নয়, বক্ষভাগের মাঝের অংশও ছিল উন্মোচিত। গাউনের উপর যে অবগুণ্ঠন ছিল, সেটি একেবারে স্বচ্ছ ছিল। তেহরানের বিলাসবহুল Espinas Palace Hotel-এ এলাহি আয়োজনে বিয়ে হয় সেতায়েশের। গান-বাজনা, উচ্ছ্বাস টের পাওয়ায় যায় ভিডিওটিতেও। 

Continues below advertisement

ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া অনেক মহিলাকেই দেখে যায় আধুনিক পোশাক পরে ঘুরছেন। মাথায় হিজাব নেই, ঢাকা নেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, সেতায়েশের মা, শামখানির স্ত্রীর পরনেও ছিল নীল রংয়ের পিঠ খোলা গাউন। মাথায় কোনও ওড়না বা হিজাব ছিল না। ইরানের শীর্ষস্তরের রাজনীতিকদের প্রায় সকলেই ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। শামখানির মেয়ে ও স্ত্রী যেখানে খোলামেলা পোশাক পরছেন, সেখানে দেশের বাকি মেয়েদের কেন পোশাক বিধি মানতে বাধ্য করা হবে, ভিডিওটি সামনে আসার পর থেকেই উঠছে প্রশ্ন। 

২০২২ সালে মাহসা আমিনি মারা যাওয়ার পর ইরান জুড়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, সময়ের সঙ্গে যা রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠে। ২০২৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে হিসেব সামনে এসেছে, তাতে ওই আন্দোলনে যোগ দিয়ে কমপক্ষে ৫৫১ জন প্রাণ হারান। গ্রেফতার হন ২০০০০ মানুষ। ওই সময় দেশের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্বে ছিলেন খোদ শামখানি। তিনিই কঠোর ভাবে আন্দোলন দমন করতে নির্দেশ দেন। শামখানি বরাবর কট্টর ইসলামি নীতি চালুর সমর্থক থেকেছেন, মেয়েদের উপর যাবতীয় বিধিনিষেধ চাপানোর পক্ষে থেকেছেন। সেক্ষেত্রে তাঁর মেয়ে, স্ত্রী ও ঘনিষ্ঠজনেদের ক্ষেত্রে একই নিয়ম খাটবে না কেন, প্রশ্ন উঠছে। 

শামখানির মেয়ের বিয়ের ওই ভিডিও সামনে আসতেই সরব হয়েছেন সাধারণ মানুষ, মানবাধিকার কর্মী থেকে দেশের নির্বাসিত সমাজকর্মী মাসিহ আলিনেজাদ। তাঁর বক্তব্য, ‘আলি শামখানি, যিনি ইরানের অন্যতম শীর্ষ আইনপ্রণেতা, তাঁর মেয়ে কাঁধ খোলা পেশাকে বিয়ে করছেন। অথচ মাথার চুল দেখা গেলে ইরানের অন্য মেয়েদের মারধর করা হয়। দেশের তরুণ প্রজন্মের এভাবে বিয়ে করার সামর্থ্যও নেই। খামেনেই সরকার লাঠি উঁচিয়ে, গুলি ছুড়ে অন্যদের ইসলামি মূল্যবোধ শেখায়, কিন্তু নিজেদের বেলায় তা কার্যকর হয় না। খামেনেইয়ের শীর্ষ উপদেষ্টা প্রাসাদে মেয়ের বিয়ে উদযাপন করেছেন। আর এই সরকারই মাহসা আমিনিকে খুন করেছে, কারণ তার চুল দেখা যাচ্ছিল। গান গাওয়ার জন্য মেয়েদের জেলে পোরে এরা। মেয়েদের টেনে গাড়িতে তুলতে ৮০০০০ নীতি পুলিশ নিয়োগ করে, আর নিজেরা বিলাসিতা করে। এটা দ্বিচারিতা নয়, এটাই সিস্টেম।  অন্যের বেলায় নীতিগিরি, আর নিজের মেয়ে ডিজাইনার গাউন পরে ঘুরছে। এর চেয়ে স্পষ্ট বার্তা কিছু হতে পারে না। নিয়ম শুধু আপনাদের জন্য, ওদের জন্য নয়’।

ইরানের সংবাদমাধ্যমের একাংশও বিষয়টি তুলে ধরেছে। নীতি-নিয়ম দেখিয়ে সরকারি অধিকারিকরা সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিসহ করে তুললেও, নিজেরা তা মানেন না বলে মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক আমির হোসেন মোসাল্লা। ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘Shargh’ প্রথম পাতায় শামখানির-সহ শিরোনামে লেখে, ‘কেচ্ছায় নিমজ্জিত’। শামখানির সমালোচনা করেছে ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডসের সাহায্য় প্রাপ্ত সংবাদ সংস্থা Tasnim-ও। 

যদিও Iran International-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভিডিওটি ফাঁস হওয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন শামখানি। সরাসরি ইজরায়েলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, “অন্যের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারে হস্তক্ষেপ করাই ইজরায়েরলের নতুন অভিযান হয়ে উঠেছে।” শামখানিকে আবার সমর্থন করেছেন দেশের প্রাক্তন মন্ত্রী এদাতোল্লা জারঘামি। তাঁর মতে, ওই অনুষ্ঠানটি ছিল নারীকেন্দ্রিক। সেখানে গোটা সময় মাথা নীচু করে ছিলেন শামখানি। যদিও এই যুক্তি ধোপে টিকছে না। শামখানির পদত্যাগের দাবি উঠছে। কারণ যে সময় ভিডিও-টি ফাঁস হয়েছে, ইরান নতুন করে ৮০ হাজার নীতি পুলিশ মোতায়েনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যারা মেয়েদের পোশাকের উপর নজর রাখবে। চলতি জুন মাসে নতুন আইন আনা হয়েছে দেশে। বলা হয়েছে, জনসমক্ষে হিজাব না পরলে ১২ ঊর্ধ্ব মেয়েদের জেল হতে পারে, চাবুকপেটা করা হতে পারে।