সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা: উত্তর ভারতীয় প্রথায় দিওয়ালি আসলে পাঁচদিনের উৎসব। এই পাঁচদিনের উৎসব বাংলার অঙ্গীভূত হয়েছে বটে, তবে  তার কিছুটা পরিবর্তন ও পরিমার্জন ঘটেছে এই বাংলায় এসে। দেখে নেওয়া যাক এই পাঁচ দিন গোটা ভারতে বিশেষত উত্তর ভারতে কিভাবে পালিত হচ্ছে আর বাংলাতেই বা কিভাবে পালিত হচ্ছে।


ধনতেরাস বা ধনত্রয়োদশী

কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে উৎসব শুরু হয় ধনতেরাস দিয়ে। উত্তর ভারতের ধনতেরাসই বাংলার ধনত্রয়োদশী। এই তিথিতে ধন্বন্তরী, লক্ষ্মী, কুবের ও যমের পুজো করা হয়। কথিত আছে সত্যযুগে দেবাসুর যখন অমৃতের জন্য সমুদ্রমন্থনে রত তখন ক্ষীর সাগর থেকে উঠে এলেন দেব চিকিৎসক ধন্বন্তরী। তাঁকে বিষ্ণুর এক রূপ বলেই ধরা হয়। সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবনের জন্য সবাই তাঁর পুজো করে। এর সঙ্গে উঠে এলেন লক্ষ্মীদেবী। তাই এই দিন ধন-সম্পদের জন্য লোকেরা লক্ষ্মীপুজোও করে থাকে। একই ভাবে কুবেরের কাছে থাকে দেবতাদের সম্পদ। তাই ধন-সম্পদের জন্য ঐদিন কুবেরের পুজোও প্রচলিত। একইসঙ্গে প্রতিটি বাড়ির মূল প্রবেশ পথে ঐদিন মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হয় যা যমরাজের উদ্দেশ্যে। মানুষের বিশ্বাস এই দিন কোন ধাতব দ্রব্য কিনলে তা পরিমাণে তেরো গুণ বৃদ্ধি পায়। এই ধারণা থেকেই ধনতেরাসে সোনা কেনার প্রচলন হয়েছে। এবছর ত্রয়োদশী তিথি পড়েছে ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাত ৯:৩০ মিনিটে। ত্রয়োদশী তিথি থাকবে পরের দিন অর্থাৎ ১৩ তারিখ বিকেল ৫:৫৯ মিনিট পর্যন্ত। ধনতেরাসের পুজোর জন্য সূর্যাস্তের পর প্রদোষ কাল সবচেয়ে শুভ মুহূর্ত ধরা হয়। এবছর প্রদোষের পুজোর জন্য শুভ সময় ১৩ তারিখ বিকেল ৫:২৮ থেকে রাত ৮:০৭ পর্যন্ত। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে শুভ বৃষভ কাল হল বিকেল ৫:৩২ থেকে সন্ধ্যে ৭:২৮ পর্যন্ত।

নরক চতুর্দশী বা ভূত চতুর্দশী

দীপান্বিতা অমাবস্যার আগের দিন অর্থাৎ কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি হল ভূত চতুর্দশী। সেদিন চোদ্দ ভুবনের অধীশ্বরী দেবীর উদ্দেশ্যে ১৪ দীপ দান করা হয় এবং চোদ্দ শাক খাওয়ার রীতি রয়েছে।  এই চোদ্দ শাক হল- ১) ওল, ২) কেঁউ, ৩) বেতো, ৪) সর্ষে, ৫) কালকাসুন্দে, ৬) নিম, ৭) জয়ন্তী, ৮) শাঞ্চে, ৯) হেলেঞ্চা, ১০) পলতা, ১১) শুলফা, ১২) গুলঞ্চ, ১৩) ভাঁট পাতা, ১৪) শুষনি শাক।



কালীপুজো, দিওয়ালি ও লক্ষ্মী-গণেশের পুজো

কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথি কে বলা হয় দীপান্বিতা অমাবস্যা। বাংলায় ঐদিন কালী পুজো করা হয়। কালী পুজো নিশীথকালীন পুজো। তাই অমাবস্যা যুক্ত রাতে কালী পুজো করা হয়। ১৪ নভেম্বর দুপুর ২:১৮ থেকে পরের দিন ১৫ নভেম্বর সকাল ১০:৩৭ পর্যন্ত অমাবস্যা তিথি থাকছে।

উত্তর ভারত জুড়ে সেদিন দিওয়ালি। রাবণ বধের পর রামচন্দ্রের অযোধ্যায় ফেরার দিন। রামচন্দ্রের ঘরে ফেরার আনন্দে মেতে উঠে দেশবাসী সেদিন আলোর মালায় সাজিয়ে তোলেন নিজের ঘর।

সমগ্র উত্তর ভারতে ঐদিন লক্ষ্মী- গণেশের পুজো করা হয়। ব্যবসায়ীরা নতুন হিসাবের খাতা করেন। উত্তর ভারত থেকে (প্রধানত: কনৌজ থেকে) যারা বঙ্গদেশে এসেছিলেন তারা ঐদিন লক্ষ্মী পুজোর ধারাটিও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। তাই পশ্চিমবঙ্গীয় রীতিতে ঐদিন সন্ধ্যায় অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মী আরাধনা করা হয়। এই লক্ষ্মী পুজো প্রদোষকালীন পুজো। ১৪ নভেম্বর বিকেল ৪:৫০ থেকে সন্ধ্যে ৬:২৬ মধ্যে প্রদোষ যোগ রয়েছে।

গোবর্ধন পুজো বা অন্নকূট

ভাগবত পুরাণ অনুসারে মহাপ্রলয়ের রাতে গোবর্ধন পর্বত কে তুলে ধরে সমগ্র বৃন্দাবন বাসীকে রক্ষা করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। তাই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে বৃন্দাবনবাসী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নানা ধরনের ভোগ নিবেদন করেন। প্রধানত  ভাতের পাহাড় করে নিবেদন করা হয়। ভাত অর্থাৎ অন্ন। পাহাড় হল কূট। তাই এই উৎসবের নাম অন্নকূট। কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে এই পুজো হয়ে থাকে।