করোনা আতঙ্কে কাবু সারাদেশ। এর মধ্যে ভয় বাড়াচ্ছে দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা। শিশুদের মধ্যে করোনার উপসর্গ গুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব একটা ভয়াবহ না হলেও চিন্তা ধরাচ্ছে কোভিড পরবর্তী একটি অসুখ। যা ইদানিংকালে বেশ কিছু বাচ্চাকে ঘায়েল করেছে। মাল্টি সিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোম ইন চিলড্রেন (Multi System inflammatory syndrome) । একেবারে সদ্যোজাত থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার দোরগোড়ায় পৌঁছানো ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই এই রোগ দানা বাঁধতে দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবন কেড়ে নিচ্ছে এই অসুখ। বিস্তারিত আলোচনা করলেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়দেব রায়( Prof and head of pediatrics) ।
কোভিড থেকে সেরে ওঠার পরেই এই রোগ হতে দেখা যাচ্ছে। চিকিত্সা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা আক্রান্ত হয়েছে একথা জানতেই পারেননি অভিভাবকরা। কারণ তাদের কোনও রকম উপসর্গই হয়নি। হয়ত পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেখান থেকে হয়ত সংক্রমিত হয়েছিল শিশুটিও। কিন্তু পরিবারের মানুষ জানতেই পারেননি।
পরে দেখা গেছে জ্বর-জ্বালা সহ আরও কিছু উপসর্গ। কোনওভাবেই জ্বর না ছাড়ায় যখন বাবা-মা বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে আসছেন, তখন দেখা যাচ্ছে শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি রয়েছে। অর্থাত্ সে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিল। খুব বেশি বাড়াবাড়ি হলে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
কী কী উপসর্গ মূলত দেখা যাচ্ছে ?
- তিন চারদিন ধরে ওষুধ খেয়েও জ্বর কমছে না । জ্বরের কোনও কারণ বোঝা যাচ্ছে না । এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকেও কাজ হচ্ছে না । ক্রমে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে। সেইসঙ্গে আরও বেশ কিছু মারাত্মক উপসর্গ চোখে পড়ছে । শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জয়দেব রায় জানালেন ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ-এ গত বছর থেকে একশোরও বেশি শিশু ভর্তি হয়েছে এই অসুখ নিয়ে । চিকিৎসকরা মনে করছেন প্রাথমিক স্তরেই যদি অভিভাবকরা আক্রান্ত শিশুটিকে নিয়ে আসেন তাহলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে রোগীকে সুস্থ করা যাচ্ছে নচেৎ চিকিৎসা জটিলতা বাড়ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু ঘটছে। অসুখ একটা স্তরে পৌঁছে গেলে বাচ্চার শরীরে বিভিন্ন অরগ্যান আক্রান্ত হচ্ছে। সেই সময় রোগীকে সুস্থ করে তোলা কঠিন হয়ে পড়ছে ।
- কাওয়াসাকি ডিসিজের মতো বেশ কিছু উপসর্গ ধরা পড়ছে । যেমন -
- কনজাংটিভাইটিস এর মত চোখ লাল, কিন্তু পুঁজ নেই ।
- ঠোঁট ফেটে যাচ্ছে। লাল হয়ে থাকছে।
- গায় Rash দেখা যাচ্ছে।
- গলার গ্ল্যান্ড ফোলা দেখা যাচ্ছে ।
- এসব উপসর্গ গুলি দেখামাত্র সাধারণ জ্বর বা ঋতু পরিবর্তন কালীন অসুস্থতা না ভেবে সরাসরি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া শ্রেয় ।
- সেইসঙ্গে যদি দেখা যায় বাচ্চাটির মাস দুয়েকের মধ্যে করোনা হয়েছে কিংবা বাড়ির কারও করোনা হয়েছে অথচ বাচ্চাটির করোনা পরীক্ষা করানো হয়নি সে ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। সময় নষ্ট না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার ।
অসুস্থতা একটু বেশি দূর গড়িয়ে গেলে দেখা যায় এই অসুখ ক্ষতি করছে হৃদপিন্ড ও ফুসফুস, কিডনি , মস্তিষ্ক , শ্বাসনালী, খাদ্যনালী , চোখ ত্বক, ইত্যাদিরও।
সমস্যা জটিল হলে আর কী কী ঘটতে পারে ?
- বমির প্রবণতা
- ডায়রিয়া
- পেটে যন্ত্রণা
- শ্বাসকষ্ট
- বুক ধড়ফড় করা
- দ্রুত শ্বাস নেওয়া
- ত্বকে গুটি গুটি rash
- শরীর অবসন্ন ভাব
- মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিচ্ছে
এই উপসর্গ নিয়ে রোগী এলে কী কী পরীক্ষা করছেন ডাক্তাররা ?
- শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা সেই পরীক্ষা করাচ্ছেন চিকিৎসকরা । দেখা যাচ্ছে আক্রান্ত বাচ্চাদের করোনা অ্যান্টিবডি পজিটিভ।
- সেই সঙ্গে আরও একটি পরীক্ষা করাতে হচ্ছে সেটি হচ্ছে ইনফ্লামেটরি মার্কার। যদি দেখা যায় শরীরে ইনফ্লামেটরি মার্কারগুলি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি, আছে তাহলে বুঝতে হবে শিশুটি এই অসুখে আক্রান্ত ।
- সাধারণত দেখা যাচ্ছে কোভিড থেকে সেরে ওঠার দুই থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা ।
এমনিতেই কোভিড আক্রান্তদের মধ্যে বাচ্চাদের আক্রান্ত হওয়ার হার কম । তার মধ্যে খুবই কম সংখ্যক এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে । তবু যারা এই অসুখে পড়ছে তাদের যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে, ততই সুস্থতার সম্ভাবনা বেশি। চিকিৎসক রায় জানালেন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে শক সিনড্রোম হয়ে যাওয়ার পরেও বাচ্চাকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠানো যাচ্ছে । কোনও কোনও ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্র বা শরীরের অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত করার পরও এই অসুখ থেকে সারিয়ে তোলা যাচ্ছে শিশুকে। তবে বেশি দেরি হলে লড়াইটা অত্যন্ত কঠিন ।
চলতি মাসে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পার্ক সার্কাসের বেসরকারি শিশু হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে ২ শিশুর। মে মাসের শুরুতেই এই রোগে ৯ মাসের এক শিশুর মৃত্যু হয়। শুক্রবার প্রাণ হারায়, হাওড়ার বাসিন্দা ৭ বছরের আরেক শিশু।