পল্লবী দে, কলকাতা: করোনাভাইরাসের হানায় গত বছর থেকেই কখনও পুরো বন্দি কখনও আবার আংশিক বন্দি হয়েছে জীবন। আর পুজো? কোথায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের আমেজ? বরং ভাইরাস আতঙ্কেই ঘরবন্দি হয়েছে উদযাপন। তাই আজও মনের কোণে সেই ফেলে আসা শৈশবের সেই দিনগুলিকেই বারবার আগলে রাখি। এ বছর স্মৃতির সেই ধুলো ঝেড়ে এবিপি লাইভের সঙ্গে ছেলেবেলার পুজোয় ফিরলেন বিশিষ্ট কবি, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক রতনতনু ঘাটী।
ছেলেবেলা কেটেছে মেদিনীপুর জেলার মহিষাদল থানার রাজারামপুর গ্রামে। কবির কথায়, "ছেলেবেলায় দুর্গা পুজো দেখার সৌভাগ্য হত আমাদেরই গ্রামের রায়বাড়ির বারোয়ারি পুজোয়। তখন মেদিনীপুর জেলা এমন করে দু’ টুকরো হয়নি। থানা-শহর ছিল প্রায় সাত মাইল দূর। পায়ে-হাঁটা পথ। তাই শহরের দুর্গাপুজো দেখতে পাইনি ছেলেবেলায়। তখন গ্রামের পথঘাট এখনকার মতো এমন লাল মোরামের রং আর আদর পায়নি। কংক্রিট রোড? সে ছিল স্বপ্নেরও অদূর। তখন কেমন করে যেন ফি বছরই পুজোর আগে-আগে ধুম মেঘে সেজে বৃষ্টি আসত আমাদের গ্রামে বেড়াতে। তাকে থাকতে না বললেও সে থেকে যেত বিজয়া তক।"
গ্রাম আর পুজো বলতেই তবে প্রথমে কী মনে পড়ে? শিশুসাহিত্যিক জানান, "তখন বইয়ে পড়ে বা সিনেমার‘পথেরপাঁচালী’ দেখে আমরা কাশ ফুল চিনতে শিখিনি। মাঠের আল ধরে ছুটতে ছুটতে কাশ ফুল পাড়তাম। সে কাশের রং ছিল কী সাদা, কী সাদা"
সেই কাশের গুচ্ছ নিয়েই রতনতনু ঘাটী ছুটলেন ছেলেবেলার পুজোর দিনগুলিতে। অনিমেষে বলে চলেন, " শুধু একখানাই দুর্গাপুজো হত আমাদের গ্রামে। আর একখানা পুজো হত সাত মাইল দূরের মহিষাদলের বারোয়ারি পুজো। আরও একখানা পুজো হত, মহিষাদলের রাজাদের, পুরনো রাজপ্রাসাদের ভিতরে। ছেলেবেলায় আমি কক্ষনো যাইনি রাজা দেবপ্রসাদ গর্গদের দুর্গাপুজো দেখতে। কাদা মাখামাখি হয়ে পুজে মণ্ডপে দাঁড়িয়ে ভাবতাম, রাজকন্যারা নিশ্চয়ই সে পুজোর প্রতিমা দেখতে আসত রাজপালকিতে চড়ে। আমি গ্রামের যাত্রাপালায় ছাড়া কখনও রাজকন্যা দেখিনি।"
আরও পড়ুন, দেবী দুর্গার আগমনই কি কারণ ? কেন বলে মহালয়া ?
"আমাদের গ্রামের বনেদি রায়পরিবারের দুর্গাপুজোই ছিল আমাদের পুজো। আমিও গলা উঁচু করে পাশের গ্রামের বন্ধুদের সে কথা বলতাম। আমি ছেলেবেলায় এক-একজন অন্য গ্রামের এক-একজনকে নেমন্তন্নও বসতাম। বলতাম, ‘আসিস কিন্তু আমাদের গ্রামে আমাদের পুজো দেখতে!’ তখন গ্রামের মানুষের মধ্যে এখনকার মতো রং-বেরঙের দল-বিদলের মানচিত্র আঁকা হয়নি। কেউ কাউকে পেশি দেখাত না। সম্ভবত তখন পেশি ছিলও না হয়তো কারও। থাকলেও জামার মধ্যে তা লুকনো থাকত। এখনকার মতো পেশি-দেখানোর গৌরব ছিল না জনসমক্ষে।"
এরপরই রতনতনু ঘাটীর স্মৃতিতে যেন সেই গান ভেসে আসে, "কে জানে, এতক্ষুণে হয়ত মায়ের মুখ হল রঙ করা!
আনমনা ওই ছেলেরা সব, থাক্ না এবার পড়া!
মন বসে না আর!"
তাঁর কথায়, "আমার স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তা ছিল রায়পাড়ার পাশ দিয়ে। টানা মাস খানেক ধরে আমরা দল বেঁধে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক-একদিন একহাঁটু কাদা ঠেলে রায়বাড়ির পুজো মণ্ডপটা ঘুরে আসতাম। কোনওদিন গিয়ে দেখতাম, প্রতিমার কাঠামো তৈরি হচ্ছে। আবার একদিন দেখলাম, খড় দিয়ে প্রতিমার আদল ফুটিয়ে তুলছে পটুয়া। কোনও দিন আমি না গেলে বন্ধুদের মুখ থেকে খবর পেয়ে যেতাম, প্রতিমার আরও কী কী তৈরি হয়ে গেল? একটা খবর আমরা পটুয়াদাদুর কাছে জানতে চাইতাম, ‘দাদু, ও দাদু, বলো না, কবে ঠাকুরের চোখ ফুটবে গো?’মানে কবে প্রতিমার চক্ষুদান কবে হবে জানতে চাইতাম। দাদু কখনও মুখ গম্ভীর করে বলত, ‘সে এখন বলা যাবে না! পরে জিগাইও!’ কিন্তু দেখতাম, দাদু ঠিক মনে করে প্রতিমার চক্ষুদানের দিনটা আমাদের আগেভাগে জানাতে ভুল করত না। সেদিন আমরা অনেক ছেলেমেয়ে সকাল থেকে পুজো মণ্ডপে ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। সাবেকি প্রতিমা। এখনকার মতো থিম পুজোর ঢেউ আসেনি তখন বাংলার গ্রামের পুজোয়। প্রতিমা তো প্রতিমাই। ডাকের আর শোলার গয়নার সাজে সে কী অপরূপ মায়া ফুটে উঠত প্রতিমার মুখশ্রীতে।"
আরও পড়ুন, পুজোর বাজারে মন্দা, 'মন ভাল নেই' বস্ত্রবিপণীদের, তবে রমরমিয়ে বাড়ছে অনলাইন শপিং
পুজোর স্মৃতিতে ধরা রয়েছে স্বাধীনতার সময়কালও। সেই স্মৃতি আবছা হলেও শিশুসাহিত্যিকের মনে তা উঁকি দেয়। "তখন সবে আট-ন’ বছর হল ভারত স্বাধীন হয়েছে। আমার রাজারামপুর গ্রাম ছিল স্বদেশী আন্দোলনের গ্রাম। আমার গ্রামের কত মানুষ যে খদ্দরের জামা-কাপড় পরত! চরকায় সুতো কাটা হত কত বাড়িতে। সেই কবে থেকে লেগে ছিল মহিষাদলের মানুষের গায়ে ব্রিটিশকে তাড়ানোর বারুদ-গন্ধ আর দু’ চোখে কল্পনায় আঁকা নতুন ভারতের মৃন্ময়ী প্রতিমার মূর্তি। দুর্গা পুজোর বেশ কিছুদিন পরে আর-একটাও পুজো হত আমাদের গ্রামে, ভারতমাতার পুজো। বাংলার আর কোনও গ্রামে ভারতমাতার পুজো হত কিনা জানতে পারিনি। অবশ্য সে পুজোর অমন হাঁকডাকও ছিল না। তবু আমরা ছোটরা পুজো দেখতে যেতাম। সে প্রতিমার মুখ স্মৃতির আস্তরণ সরিয়ে এখন আর ভেসে ওঠে না। কৈশোরের স্মৃতি হাতড়ে আবছা যেটুকু মনে পড়ে, ভারতমাতা ছিলেন গৈরিক বসনে আবৃতা চতুর্ভুজা যোগিনী। চার হাতে রয়েছে ধান্য, বস্ত্র, বিদ্যার আকর পুঁথি, আর ধর্মসাধনার দ্যোতক জপমালা। তখন সেই শৈশব মনে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনটুকুই ছিল দাগ কেটে থাকা ঘটনা।"
এবিপি লাইভের সঙ্গে আলাপচারিতায় ভেসে ওঠে কবির ছোটবেলার সেই দিনগুলি। "তখন এখনকার মতো মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকের সিডি বাজানোর চল হয়নি। সত্যি-সত্যিই ঢাকি আসত, তার ছেঁড়া জামা পরা দুই কিশোর ছেলের হাত ধরে। আধ ময়লা গামছা কাঁধে ফেলে, তার উপর ঢাক ঝুলিয়ে। গরিব ঢাকি যখন কাঁধ থেকে তার ঢাক নামিয়ে রাখত প্রতিমার সামনে, দেখতাম, ঢাকির কাঁধে চওড়া হয়ে ঢাকের ফিতের চিহ্ন চাবুকের মতো বসে গেছে। সঙ্গে আসত ঢাকির দুই ছেলে, আমাদেরই বয়সি হবে, কি দু’-এক বছরের কম-বেশি।দুই ছেলেকে আনত ঢাকি এই জন্যেই যে, একজনের হাত ব্যথা হলে আর-একজনের হাতে চলে যেত কাঁশি। তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখতাম, ওরা কী নিখুঁত ছন্দে বাজাত! আমি নাচতাম না বড়দের সামনে। তখন ওটা ছিল বড়দের প্রতি অসৌজন্য।"
"কিন্তু একটা না বলতেই হয়। পুজোর সময় আমার কখনও নতুন জামা-প্যান্ট হত না। গ্রামে খুব যাদের আথির্ক অবস্থা ভাল, তেমন দু’-একটা বাড়ির ছেলেমেয়েরা নতুন জামা-প্যান্ট পরত। আর আমরা মুখ ঘুরিয়ে দূর থেকে তাদের নতুন জামা-প্যান্ট দেখতাম। নাকে ভেসে কখনও হাত দিয়ে ছুঁতামও। গায়ে অদ্ভুত একটা শিহরণ খেলে যেত। কিন্তু কোনও খেদ মনে স্পর্শ করত বলে আজও মনে পড়ে না। চতুর্থীর দিন থেকে আমরা প্রতিদিনই একবার না-একবার মণ্ডপে যেতামই। পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী কেটে যেত কেমন ঘোরের মধ্যে।"
এবিপি লাইভের সঙ্গে আলাপচারিতায় এটা স্পষ্ট যে, হোক সে ছেলেবেলার পুজো, কিন্তু শেষের স্মৃতি এখনও বিষণ্ণতার ডাক দিয়ে যায়। রতনতনু ঘাটীর কথায়, "যেদিন ভাসানের দিন আসত, আমরা দল বেঁধে খালি গায়ে রায়বাড়ির বড় পুকুরের পাড়ে ঘাটের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বড়রা যখন প্রতিমাকে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিতেন, অমনি আমরা অত ছেলে ঝপাং করে পুকুরের জলে। তারপর ডুবসাঁতার দিয়ে কেউ ঠাকুরের রাংতা তুলে আনতাম, কেউ ঠাকুরের কাপড়, কেউ পরীক্ষায় অঙ্কে বেশি নম্বর পাবে বলে সরস্বতীর বাণী তুলে আনত জলে ডুব দিয়ে। আমার লোভ ছিল অসুরের চকচকে খড়্গটার প্রতি। সত্যি কথা বলি, আমি কিন্তু জলে ডুব দিয়ে কখনও অসুরের জলে-ডোবা খড়্গটা তুলে আনতে পারিনি!"