কলকাতা: কলকাতা হাইকোর্টে ফের নারদ মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। পাঁচ বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চে সিবিআইয়ের মামলা স্থানান্তরের আবেদনের শুনানি চলছে। 


এদিন শুনানির শুরুতে ফিরহাদ হাকিমের হলফনামা আদালতে জমা দেন অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। হলফনামায় বলা হয়েছে, ‘গ্রেফতারের সময় প্রচুর মানুষ আসে। সবাইকে হাতজোড় করে ফিরে যেতে বলা হয়েছিল। ২০১৭-য় এফআইআরের পর একবারও তদন্তে অসহযোগিতা করা হয়নি। সিবিআই দফতরের সামনে সিসিটিভি ফুটেজ সামনে আনা হোক। এজলাসেও আদৌ মন্ত্রীরা যাননি। মন্ত্রীরা গিয়েছিলেন শুধু পরামর্শ দিতে।’


শুনানি চলাকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দাল  জানতে চান, ‘অভিযুক্ত কীভাবে জানালেন কারা কোথায় ছিলেন? এই হলফনামায় কোথায় লেখা, তিনি এই তথ্য কোথায় পেলেন?’


জবাবে অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, ‘ফিরহাদ হাকিমের আত্মীয়দের কাছ থেকে জানা গিয়েছে। তিন-চার ঘণ্টা কেউ প্রবেশ করতে পারেনি, এটা বলা যায় না। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গেই বসেছিলেন। সিবিআই সশরীরে গিয়ে চার্জশিট দিল, ভার্চুয়াল শুনানির আর্জিও জানাল। প্রভাবশালী মানে প্রমাণ নষ্ট, এমন কোনও মানেই নেই।


হেভিওয়েটদের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, ‘১২৯টি গাড়ি সেদিন ঢুকেছিল, বোঝা যাচ্ছে না সিবিআই কেন ঢুকতে পারেনি? সেদিন অন্যান্য কোর্ট চলছিল স্পেশাল কোর্টে সমস্যা হল বলে অভিযোগ সিবিআই-এর। বলা হচ্ছে হাজার মানুষের ভিড় ছিল, কোথাও দেখা গেল না। তা হলে বিশৃঙ্খলা কোথায়? 


মনু সিঙ্ঘভি আরও বলেন, সিবিআই যেন মহম্মদ আলি, প্রজাপতির মতো উড়ছে। সিবিআই প্রজাপতির মতো উড়ছে, মৌমাছির মতো হুল ফোটাচ্ছে।’


এর আগে, গতকালও হেভিওয়েটদের হয়ে জোরাল সওয়াল করেছিলেন মনু সিঙ্ঘভি। টেনে এনেছিলেন পি চিদম্বরমের প্রসঙ্গ। সওয়ালে তিনি বলেন, ‘জামিনের আবেদন বিবেচনায় ৬০০ বছরের পুরনো পদ্ধতি আছে। মূল ৩টি বিষয় বিবেচনা করেন বিচারক বা বিচারপতিরা--- পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, অসহযোগিতার কথা বিবেচনা করা হয়। বিবেচনা করা হয় তথ্য প্রমাণ লোপাটের কথাও। এই ৩টি বিষয় খতিয়ে দেখে চিদম্বরমকে জামিন দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।


সিঙ্ঘভি তাঁর সওয়ালে বলেন, ‘অভিযুক্তদের মধ্যে একজন ২০১১ থেকে মন্ত্রী, ৫০ বছর ধরে বিধায়ক। ঘটনা ঘটার এতদিন পর লোপাট করার মত আর কী তথ্যপ্রমাণ বাকি আছে? এতদিন পর অসহযোগিতার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? প্রশ্ন সিঙ্ঘভির। তিনি আরও বলেন, ‘সমাজের এত গভীরে যাদের শিকড়, তাদের পালানোর প্রশ্ন কোথায়?’


এরপর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘১৭ মে আইনমন্ত্রী নিম্ন আদালতে গিয়েছিলেন। তিনি কি ওখানে রোজ যান? নির্দিষ্ট এজলাসে থাকুন বা না থাকুন, তিনি আদালত চত্বরে ছিলেন। তিনি কি বিচারব্যবস্থাকে মানেন না? আদালতে গিয়েছিলেন কেন?


এতে অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, ‘এটা সাধারণ মানুষ বা রাজনৈতিক কর্মীদের দ্বারা সংগঠিত বিক্ষোভ নয়। এটা সাংবিধানিক পদে থাকা ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত বিক্ষোভ। প্রভাবিত হওয়ার কোনও উল্লেখ নিম্ন আদালতের বিচারক করেননি।‘


পাল্টা ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তাঁর পর্যবেক্ষণে মনু সিঙ্ঘভির উদ্দেশে বলেন, ‘উদাহরণ দেখাতে পারবেন, যেখানে বিচারক বলছেন আমি প্রভাবিত হয়েছি। আমাদের তো জানা নেই।’


১৭ মে সকালে আচমকাই  এই চার হেভিওয়েটকে গ্রেফতার করে সিবিআই।  প্রচুর কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে যান সিবিআই অফিসাররা। 


তারপর নিজাম প্যালেসে তুলে এনে তাঁদের অ্যারেস্ট মেমোতে সই করানো হয়। স্বাভাবিকভাবেই পাঁচ বছর আগের নারদ-মামলায় একসঙ্গে চার হেভিওয়েটের গ্রেফতারি সাড়া ফেলে দেয় রাজ্য রাজনীতিতে। কিন্তু, তারপর এই বিষয়টি নিয়ে আইনি লড়াই একের পর এক নতুন বাঁক নেয়। 


১৭ মে অর্থাৎ গ্রেফতারের দিন সন্ধেতেই চার হেভিওয়েটকে জামিন দেয় বিশেষ সিবিআই আদালত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই  নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টে পৌঁছে যায় সিবিআই। রাতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দালের ডিভিশন বেঞ্চ নিম্ন আদালতের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দিয়ে দেয়।  ফলে জেল হেফাজতে যেতে হয় চার হেভিওয়েটকে। 


২১ মে  চার হেভিওয়েটের জামিন-মামলার শুনানিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দাল এবং বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতভেদ তৈরি হয়।   


শেষমেশ চার হেভিওয়েটকে গৃহবন্দি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। ডিভিশন বেঞ্চে দুই বিচারপতির মধ্যে মতভেদ তৈরি হওয়ায়, মামলাটি পাঠানো হয় হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে। গত সোমবার পাঁচ বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চে এই মামলার প্রথম শুনানি ছিল। 


কিন্তু, তার আগে রবিবার রাতেই  চার হেভিওয়েটকে গৃহবন্দি রাখার নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায় সিবিআই। সেই আবেদনে কিছু ত্রুটি থাকায় পরদিন, সোমবার ফের নতুন করে আবেদন জানানো হয়। সেদিনই কলকাতা হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে জামিন-মামলার শুনানি ছিল। 


পরদিন সুপ্রিম কোর্টেও নারদ-মামলার শুনানিতে বড়সড় ধাক্কা খায় সিবিআই। চার হেভিওয়েটকে গৃহবন্দি রাখার নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গেলেও, সেখানে বিচারপতিদের একের পর এক কড়া প্রশ্নের মুখে পড়েন সিবিআইয়ের আইনজীবী।


এরপরই হাইকোর্টে মামলা ফেরত পাঠানোর পক্ষে সায় দেন সলিসিটর জেনারেল। নিজেরা মামলা করে, নিজেরাই সেই মামলা প্রত্যাহার করে তারা। ফলে মামলা আবার ফিরে আসে কলকাতা হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে। সেই বেঞ্চই চার হেভিওয়েটের অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করে। 


বর্তমানে পাঁচ বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চে সিবিআইয়ের মামলা স্থানান্তরের আবেদনের শুনানি চলছে।